সংবাদ কী? যা কিছু ছাপাযোগ্য তা-ই সংবাদ। আসলেই কি তা ঘটে? যা কিছু ছাপা হয় বা প্রকাশ হয়, সবই কি সংবাদ?
সংবাদ নিয়ে আদি বিতর্ককে একপাশে সরিয়ে রেখে যদি মেনেও নিই সে কথা। তবুও দুটো কথা আছে। জনপ্রিয় বাংলা ওয়েবসিরিজ মহানগর এর ট্র্যাজিক হিরো ওসি হারুনের ভাষায় বললে- সংবাদ নিয়ে সবসময় দুটো কথা মনে রাখবেন-
১। যা কিছু প্রকাশযোগ্য, তাহাই সংবাদ।
২। সব সংবাদই প্রকাশ উপযোগী নহে।
সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক আলাপে বলা হয়, একটি ‘তথ্য’ সংবাদ হয়ে উঠতে তার কিছু উপাদান দরকার হয়। সাংবাদিকতার পরিভাষায় যাকে বলে ‘সংবাদের মূল্য নির্ধারণী উপাদান’। সংবাদের রকমভেদে উপাদানের গুরুত্বও আলাদা আলাদা হয়। সংবাদ সম্পাদনায় একটি সাধারণ ঘটনাকে দেখা হয় গণিতের সহজ-সাধারণ মতে। যেমন: ১টি দুর্ঘটনা + ১টি মৃত্যু = সংবাদ। সেভাবে ১টি দুর্ঘটনা + ২টি মৃত্যু = বড় সংবাদ। আবার ১টি দুর্ঘটনা + ১ জন সেলিব্রিটির মৃত্যু = সাংঘাতিক সংবাদ।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি- ১ জনের মৃত্যুর তথ্য ২ জনের মৃত্যুর তথ্যের মধ্যে খবরকে বড় করে তুলেছে। একাধিক মৃত্যু সেই খবরকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। যখন খ্যাতি এসে যুক্ত হলো, তখন মৃত্যুর খবরটি আর আগের দুটি সাধারণ খবরের মতো রইলো না। সেলিব্রিটি এসে সংবাদের রূপ-রস-গন্ধ সবই বদলে দিলো। সংবাদের পাঠশালায় গণিতের ক্লাস শেষে তখন শুরু হয় রসায়নের ক্লাস।
কোনো তথ্যে যখন খ্যাতি বা গুরুত্ব গাণিতিক নিয়ম (সংখ্যাতাত্ত্বিক)কে হটিয়ে দেয়, তখন তথ্যের উপাদানের ‘বিক্রিয়া’ সংগঠিত হয়। ১ জন সেলিব্রিটির খবর তাই ২ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
রসায়ন হলো এমন একটি ‘বিশেষ’ বিক্রিয়া যা গণিতের হিসাবকে উড়িয়ে দেয়। পৃথিবীর সব পদার্থের একটি গুণগত ও পরিমানগত পরিবর্তন ঘটে। যাকে বলে বস্তুর রূপান্তর। তেমনি সংবাদেরও রূপান্তর ঘটে তার ভিন্ন-ভিন্ন উপাদানের কারণে, সেটিই সংবাদ রসায়ন। ‘সংবাদ রসায়ন’ বা ’নিউজ কেমেস্ট্রি’ সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। আমার এই আলোচনার প্রসঙ্গঃ সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক পরিসর থেকে ঢাকার মেয়রকন্যা বুশরা আফরিনকে ‘হিট অফিসার’ পদে নিয়োগ নিয়ে সংবাদের সমীকরণ সন্ধান এবং বাঙালির ফেসবুক ট্রোলের মাত্রার অনুসন্ধান করা।
বুশরার ঘটনাটি চারটি মোক্ষম উপাদানের সংমিশ্রণ ছিলো। চারটি পৃথক উপাদানের রাসায়নিক বিক্রিয়া এই তথ্যকে জাতীয় সংবাদে পরিণত করে। যেমন:
১. গুরুত্ব (এই গরমে ঢাকায় যে হালকা বাতাস বইছে, তা লু হাওয়ার মতো গায়ে বিঁধছে। রাজধানীতে এবার গত ৬০ বছর আগের গরমের সাথে তুলনা হয়েছে। ফলে এই গরমকালে উষ্ণায়ন কমানোর ‘হিট অফিসার’ নিয়োগের তথ্যটি গুরুত্ব পেয়েছে। হিট অফিসার পদটি নতুন। বাংলাদেশের জন্য তো বটেই, এশিয়ার সর্বপ্রথম হিট অফিসারও বুশরা!
২. প্রসিদ্ধি (বুশরা নিজে মিডিয়া সেলিব্রিটি বা খ্যাতিমান কেউ না হলেও তার বাবা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। বুশরার বাবা মেয়র আতিক ব্যবসায়ী সংগঠন বিজিএমইএ সহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের নেতা ছিলেন। তিনি একজন সিআইপি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লিগের সমর্থনে তিনি ২০২০ সালে মেয়র নির্বাচিত হন।
৩. নৈকট্য (ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ার সুবাদে, এই সংবাদে বাংলাদেশীদের আগ্রহ বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক)।
৪. যৌনতা (বুশরা একজন নারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি আপলোড করা ছবিগুলোতে যথেষ্ট আবেদন তৈরি করেছেন। সেসব ছবিগুলোই গণমাধ্যমে প্রাধান্য পেয়েছে। আবেদনময় উষ্ণতার সাথে ‘হিট অফিসার’ শব্দটার দ্ব্যর্থবোধক অর্থ পাওয়া যায়)।
সংবাদের একটি উপাদানের সাথে অপরটির মিলে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে ‘সংবাদ-রসায়ন’। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, আলী আর রাজী ‘সংবাদ-রসায়ন’ (‘সাংবাদিকতা- প্রথম পাঠ’ গ্রন্থের ১৭৩ পৃষ্ঠায়) আলোচনায় বলছেন, ‘রসায়নের এই প্রক্রিয়ায় অনুরূপ ঘটনা ঘটে যখন সংবাদের একটি উপাদানের সাথে আরেকটি উপাদান সংযুক্ত হয়।… অধিকাংশ সংবাদই তৈরি হয় একাধিক সংবাদ উপাদানের সংমিশ্রণে। এমন সংবাদের উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যায় যেখানে একটি মাত্র উপাদান দিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে।… এইভাবে এক সংবাদ উপাদানের সাথে আরেকটি সংবাদ উপাদান সংযুক্ত হয়ে সংবাদের নতুন মাত্রার শক্তি লাভ লাভের প্রক্রিয়াকে বলে সংবাদ-রসায়ন।’ হ্যাঁ, রসায়ন বিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা- পদার্থের বিক্রিয়া। সংবাদের একটি উপাদানের সাথে অপরটির মিলে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে ‘সংবাদ-রসায়ন’। সাংবাদিকতায় এই ধরণের ঘটনা প্রায়শই দেখা যায়। ‘সংবাদ-রসায়ন’র সহজ উদাহারণে বলা যায়,পান + চুন + জর্দা + সুপারি = লাল রঙের পিক! এখানে পান, চুন, জর্দা কোনটারই স্বতন্ত্র লাল রঙ উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। কিন্তু এসব উপাদানের চিবুনি [যৌথ বিক্রিয়ায়] লাল পিক উৎপন্ন হয়। যোগাযোগবিদ্যার হলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের সবচেয়ে সৃজনশীল অধ্যায়ের নাম রসায়ন। মানুষের মানুষের সম্পর্ক যেমন মনের রসায়ন, তেমনি সংবাদে একটি উপাদানের সাথে ভিন্ন একটি উপাদানের সমন্বয় হলে তাকে সংবাদ রসায়ন বলা হয়।
বিশ্বের সমস্ত বাজার দখলের জন্য পুঁজিপতিরা পন্য নিয়ে তাদের নিজ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চালু আছে সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা। এই সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টাটি মূলত মিডিয়াসৃষ্ট। অপ্রয়োজনীয় পন্যকে প্রয়োজনীয় করে তোলা, অ-খবরকে মহা গুরুত্বপূর্ণ খবরে পরিণত করাসহ আরো অ-হেতুকে হেতু করে তোলার মহান দায়িত্ব নিয়েছে মিডিয়া। গণসমাজের কঠিন বাস্তবতার সামনে কর্পোরেট কালচার এইভাবে অখবরকে ‘ব্রেকিং’ বা ‘প্রথম পৃষ্ঠা’র মহাগুরুত্বপূর্ণ খবর করে তুলছে। বুশরা যদি ঢাকাইয়া উদাহারণ হয়, তবে বৈশ্বিক ঘটনা কখনো ঐশ্বরিয়ার সন্তান প্রসব, কখনো অ্যাঞ্জোলিনা জোলির স্তন কর্তন, কখনো বা কেট মিডলটনের সন্তান প্রসবের সংবাদ ফ্যান্টাসি।
তাহলে বুশরার সংবাদ নিয়ে কী দাঁড়ালো?
১. কোন সংবাদ এর পুরোটা ধৈর্য সহাকারে পড়ে জানার মতো ধৈর্য আমাদের নাই। হিট অফিসার পদে বুশরার কাজ কী, এই পদটি কেন সৃষ্ট, কিভাবে তিনি এই পদে এলেন তা অনুসন্ধানের চেয়ে ‘হিট অফিসার’ নামক পুরুষালী উপমা তৈরি করি আমরা।
২. ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এই পরিস্থিতিকে খুবই অপেশাদারীভাবে মোকাবেলা করেছে। তাদের জনসংযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
৩. সংবাদ মাধ্যমগুলোর অনলাইন/ডিজিটাল শাখা বুশরাকে ‘হিট কনটেন্ট’ এ পরিণত করেছে। ফেসবুকের আমজনতা সেই ফাঁদে পা দিয়েছে।
৪. বুশরার বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্যায়তনিক সৌন্দর্যের চেয়েও দৈহিক সৌন্দর্য-ই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো।
আমার লেখার যে অংশটুকু পাঠককে তৃপ্তি দেয়, সেটুকু বর্তমানের জন্য। আর যে অংশ ক্ষুব্ধ করে, সেটুকু ভবিষ্যতের আলাপের জন্য তুলে রাখলাম। লেখাটি শেষ করি প্রথাবিরোধী বাঙালি অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের দুটি প্রবচনকে একসঙ্গে রেখে। ওসি হারুণের মতো করে বললে-
১. ‘আমাদের অঞ্চলে সৌন্দর্য অশ্লীল, অসৌন্দর্য শ্লীল। রূপসীর একটু নগ্ন বাহু দেখে ওরা হইচই করে, কিন্তু পথে পথে ভিখিরিনীর উলঙ্গ দেহ দেখে ওরা একটুও বিচলিত হয় না’।
২. ‘বাঙালি তার এলাকার সকলের সমস্ত খবর রাখে, খারাপ খবরগুলো মুখস্থ রাখে; এবং যদি কারো কোনো খারাপ খবর না থাকে, তবে বাঙালি একটা খারাপ খবর তৈরি করে।’
বুশরা কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে Global Development Studies এ উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছেন। কাজ করেছেন বৈশ্বিক পরিসরে। বাংলাদেশে প্রাণী অভয়ারণ্য নিয়ে কাজ করছেন বর্তমানে। এতসব যোগ্যতায় বাঙাালির অনাগ্রহ। তাঁর আগ্রহ- “চিফ হিট অফিসার” শব্দে। বুশরার ‘হট লুক’ থেকে সৃষ্ট ‘হিট’ সহ্য করতে না পেরে তাই আমাদের এমন পুরুষালী হটকারী দশা। আর এর শুরু সংবাদ মাধ্যম থেকে। বাংলাদেশের প্রায় সবকটি সংবাদ মাধ্যমের ডিজিটাল বা অনলাইন শাখায় বুশরার সংবাদ পরিবেশনে ‘হিট কামানো’ ক্লিকবেইট নিউজ পলিসি কাজ করেছে এখানে। সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে ফেসবুক। কথায় আছে, ‘যার কেউ নেই তার ফেসবুক আছে’। কিন্তু যার শুধু ‘ফেসবুকই আছে’- তার আসলে ‘কেউ নেই’। এই ‘কেউ না থাকা’রাই বুশরাকে ট্রোল এর কনটেন্ট এ পরিণত করে নিজের অবদমিত ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়/ঘটাই।
বুশরার খবরে প্রতিক্রিয়া দেখে খুশি হওয়ার কিছু নেই, হতাশ হওয়ার কিছু নেই, মন খারাপ করারও কিছু নেই। বাঙালি নারীকে নিয়ে সংবাদ রসায়ন এই প্রথম নয়। যেহেতু নায়িকা পরীমণি, অভিনেত্রী মিথিলাসহ অনেক ঘটনায় যেহেতু হিট-ক্যামিস্ট্রি ঘটেছে হট-নিউজে। সেহেতু বাঙালির এই ফেসবুক ট্রোলকে আমরা বলতে পারি ‘হটকারী ফিজিক্স’!
এই বিশ্লেষণটি তৈরিতে তথ্য সহযোগিতা করেছেন চবি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সম্মান শ্রেণীর খাইরুল আনোয়ার কানন, মোহাম্মদ মাসুদ এবং শামীম খান