মহাকাশ জয় করেছিল যে শ্রমিক— গণমাধ্যমে গ্যাগারিন
মানুষ আজন্ম স্বাধীন। তার চেতনার মধ্যে জন্মগতভাবে লুকিয়ে থাকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সে শুধু ভূ-পৃষ্ঠেই থেমে থাকে না—তার স্বপ্ন বিস্তৃত হয় পর্বতচূড়া, অতল সমুদ্র আর মহাকাশ পর্যন্ত। ইতিহাসের প্রতিটি যুগেই মানুষ এই স্বপ্ন বাস্তব করে তুলেছে। ১২ এপ্রিল ১৯৬১—শ্রমজীবী মানুষের সেই চিরন্তন মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় এক মহান অর্জন। মহাকাশে প্রথম মানুষের পদার্পণের দিন। ইউরি গ্যাগারিনের দিন।
ইউরি ছিলেন একজন ইস্পাত কারখানার শ্রমিক। সেখান থেকেই মহাশূন্যে যাত্রা। ভস্টক নভোযানে চড়ে তিনি পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করেন। সেই অর্জন উৎসর্গ করেছিলেন দুনিয়ার মেহনতি মানুষদের প্রতি। কিন্তু আজ পুঁজিবাদ-ভোগবাদ-উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতি ও সমাজনীতি আমাদের সিলেবাস থেকে ইউরির নামটিও মুছে দিতে চায়।
গ্যাগারিন শুধুই দরিদ্র নন, তিনি ছিলেন আদর্শবাদী—একজন কমিউনিস্ট। কিন্তু আজকের কর্পোরেট মিডিয়া তাকে শুধুই ‘দরিদ্র এক রুশ যুবক’ হিসেবেই তুলে ধরতে চায়, তার রাজনৈতিক অবস্থান এবং সেই আদর্শের প্রতীকী গুরুত্বকে এড়িয়ে চলে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম, যাদের বড় অংশই রক্ষণশীল বা উদারপন্থী ধারণা বহন করে, দীর্ঘদিন ধরেই কমিউনিজমকে এক ধরনের শত্রু ভাবেই তুলে ধরে। তাদের প্রোপাগান্ডা, নাটকীয় কাঠামো ও কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতার মাঝে গ্যাগারিনের হাসিমাখা মুখ হয়ে ওঠে এক বিব্রত স্মৃতি।
সেই ১৯৬১ সালে যখন গ্যাগারিন মহাশূন্যে, তখন মাটির পৃথিবীতে ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলোতে খবর বেরোচ্ছিল—‘সোভিয়েত মহাকাশচারীরা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।’ এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, খবরের ট্রিটমেন্টে কতটা ভয়, পক্ষপাত আর গোপন অভিসন্ধি লুকিয়ে থাকে।
তবে একদিনের জন্য হলেও বিশ্ব সংবাদমাধ্যমকে থমকে দাঁড়াতে হয়েছিল। গ্যাগারিনের সংবাদ কাভার করতে গিয়ে বড় বড় সংবাদপত্রের নিউজরুমে নেমে এসেছিল উত্তেজনার ঝড়। কী হেডলাইন হবে? কোন ছবি ব্যবহার করা হবে? কোন ব্যানারে চলবে এই মহাকাব্যিক সংবাদ? সাংবাদিকতার পরিভাষায় একেই বলে—”মধ্যরাতের শিহরণ”।
গ্যাগারিন যেন এক প্রকারে মার্কসকেও ছাড়িয়ে যান। কার্ল মার্কস বলেছিলেন—“শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু নেই, জয়ের জন্য আছে গোটা দুনিয়া।” গ্যাগারিন দেখিয়ে দিলেন, শুধু দুনিয়া নয়—শৃঙ্খলমুক্ত শ্রমিক জয় করতে পারে অনন্তলোক, মহাকাশও।
গ্যাগারিন যখন পৃথিবীতে ফিরে আসেন, প্রথম সংবর্ধনা পান এক যৌথ খামারের কৃষকদের কাছ থেকে। তার হাসি, তার বিনয়, আর বিশ্বাস—সব মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন কেবল একজন মহাকাশচারী নন, শ্রমজীবী মানুষের বিজয়ের প্রতীক।
আজ এই দিনটিকে স্মরণ করতে গিয়ে প্রশ্ন জাগে—আমাদের গণমাধ্যম কি সেই উচ্চতাকে আজও ধারণ করতে পারে? না কি আমরা গ্যাগারিনকে শুধুই ফুটনোটে ঠেলে দিয়েছি?
১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন মানুষ পা রাখলেন মহাশূন্যে। তিনি ছিলেন ইউরি গ্যাগারিন, এক ইস্পাত কারখানার শ্রমিকের ছেলে, পরে যুদ্ধবিমান চালক। মহাশূন্যে যাত্রার সেই দুই ঘণ্টা তাঁকে রাতারাতি বিশ্ব নায়ক বানিয়ে তোলে।
তবে গ্যাগারিন শুধু একজন নভোচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের সম্ভাবনার জীবন্ত উদাহরণ। তাঁর অর্জন ছিল শুধু প্রযুক্তির নয়, চেতনারও।
গ্যাগারিন নিজেই লিখেছেন একটি বই—
“পৃথিবী দেখেছি” (রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ: ননী ভৌমিক, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো)।
বইতে তিনি লিখেছেন:
“একবার এক বিদেশী সাংবাদিক আমায় বলেছিলেন:
‘মি. গ্যাগারিন, ১২ এপ্রিলের পর তো আপনি সারাজীবন আরাম করে কাটাতে পারেন।’
আমি বলেছিলাম—‘বসে কাটাব? আমাদের সোভিয়েত ইউনিয়নে সবাই কাজ করে। সবচেয়ে বেশি খাটে সবচেয়ে বিখ্যাতরা। আমাদের কাজ মহাশূন্যে যাওয়ার পর ফুরোয়নি, বরং বেড়েছে।’”
এটাই ছিল গ্যাগারিনের দর্শন।
তিনি ছিলেন না পুঁজিবাদের পোস্টার বয়, ছিলেন না কোনো কর্পোরেট বিজ্ঞাপন মুখ।
তিনি ছিলেন সেই সমাজতান্ত্রিক পরিকাঠামোর প্রতীক— যেখানে একজন শ্রমিকের ছেলে হয়ে উঠতে পারে মহাকাশচারী।
আজকের দিনে, যখন শ্রমিকের অধিকার, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং ঐক্যের বোধ ধীরে ধীরে গায়েব হয়ে যাচ্ছে পাঠ্যবই থেকে—গ্যাগারিনকে স্মরণ মানে বিজ্ঞান, শ্রম ও চেতনার সম্মিলিত জয়কে স্মরণ করা।
আজ সময় এসেছে ইতিহাসকে নতুন করে পাঠ করার, সেই মহাকাশচারী শ্রমিকের হাসিমাখা মুখের দিকে আবারও তাকিয়ে বলার—তুমি আজও আমাদের অনুপ্রেরণা, তুমি আজও আমাদের ‘আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন’। আমি আকাশে পাতিয়া কান… শুনেছি ইউরি গ্যাগারিনের নাম!
চলুন সেই ঐতিহাসিক সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতা ও শিরোনামগুলো দেখে আসি –