মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে বিভ্রান্তি—কী বলছে, কে বলছে, কেন বলছে?

মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে বিভ্রান্তি—কী বলছে, কে বলছে, কেন বলছে?

বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন শুধু এক বর্ণাঢ্য রীতিই নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক, যা অসাম্প্রদায়িক চেতনার আধুনিক রূপ। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি ঘিরে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। এই বিভ্রান্তির বিশ্লেষণে হ্যারল্ড লাসওয়েলের কমিউনিকেশন মডেল—Who says what, in which channel, to whom, with what effect—একটি কার্যকরী পদ্ধতি হতে পারে।

 

Who says?

এই বিভ্রান্তিমূলক বার্তাগুলো এসেছে ধর্মীয় রক্ষণশীল গোষ্ঠী যেমন হেফাজতে ইসলাম, তৎসঙ্গে আওয়ামী লীগের আনুগত্যশীল ইসলামপন্থি সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও। হেফাজতের আমির ও মহাসচিবের সাম্প্রতিক বিবৃতি (১০ এপ্রিল ২০২৫) এবং ২০১৭ সালের আওয়ামী ওলামালীগের বক্তব্য এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ভিত্তি গড়ে দেয়।

Says what?

তাদের ভাষ্য—মঙ্গল শোভাযাত্রা “ভারতীয় ষড়যন্ত্র,” “হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি,” এমনকি “দূর্গাপূজার দর্শনের অংশ”। এই বক্তব্যে ধর্মীয় চেতনার অপব্যবহার এবং একটি সংস্কৃতি উৎসবকে ‘কুফরি’ বা ‘শিরকি’ আখ্যা দিয়ে তা বাতিল করার চেষ্টা করা হয়েছে।

In which channel?

এই বার্তাগুলো এসেছে বিবৃতি, সংবাদ সম্মেলন এবং গণমাধ্যমে (যেমন ইনকিলাব, ১৪ এপ্রিল ২০১৭)। এসব বার্তা পরিকল্পিতভাবে প্রচারিত হয়েছে ধর্মপ্রাণ জনগণের আবেগকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে।

To whom?

টার্গেটেড শ্রোতারা হলেন গ্রামীণ ও ধর্মপ্রবণ জনগোষ্ঠী, যাদের রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের সুযোগ সীমিত। তারা সহজেই ধর্মীয় ব্যাখ্যায় প্রভাবিত হন এবং উৎসব-সংস্কৃতির জটিল সামাজিক তাৎপর্য বোঝার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেন।

With what effect?

ফলাফল—একটি অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রয়াসকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, বিভাজন সৃষ্টি করা এবং রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের চেষ্টা। পাশাপাশি, সামগ্রিকভাবে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপকেই খণ্ডিত করার প্রচেষ্টা।

কলকাতার যাদবপুরে মঙ্গল শোভাযাত্রা, নববর্ষ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
কলকাতার যাদবপুরে মঙ্গল শোভাযাত্রা, নববর্ষ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ

বাস্তবতা কী বলছে?

এই প্রচারের বিপরীতে বাস্তবচিত্র ভিন্ন। কলকাতায় ২০১৭ সাল থেকে যে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়, তা ঢাকার ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত। কলকাতার মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্রের সম্পাদক বুদ্ধদেব ঘোষ স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছেন—তাঁরা বাংলাদেশের অনুসরণেই এটি শুরু করেন। অথচ, সেই সময়েই বাংলাদেশের একটি অংশ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে “কলকাতার সংস্কৃতি” বলে অপপ্রচার চালায়।

উপসংহার

মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি বাঙালি জাতিসত্তার ধর্মনিরপেক্ষ, সামষ্টিক সাংস্কৃতিক প্রকাশ। এটি পহেলা বৈশাখের মতোই উৎসবমুখরতা ও সৌহার্দ্যের প্রতীক। একে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা মানে ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিকৃতি ঘটানো।

লাসওয়েলের মডেল ব্যবহার করে যদি এই বার্তা-বিন্যাস বুঝতে পারি, তবে স্পষ্ট হয়—এই বিভ্রান্তির উৎস, মাধ্যম, লক্ষ্য এবং ফলাফল—সবই প্রণোদিত। অতএব, প্রয়োজন সাংস্কৃতিক জাগরণ, ঐতিহাসিক সচেতনতা, এবং নাগরিক দ্ব্যর্থহীন অবস্থান, যাতে মঙ্গল শোভাযাত্রা কেবল একটি উৎসব নয়, এক প্রজন্মের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের সাক্ষ্য হয়ে ওঠে।

লেখক : রাজীব নন্দী, সহযোগী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়