পাঠ প্রতিক্রিয়া
ভয়ের সংস্কৃতি: অব্যর্থ ভবিষ্যদবাণীর দালিলিক ভাষ্য
ভয় দ্বারা তাড়িত সংষ্কৃতির নাম ‘ভয়ের সংস্কৃতি’। রাজনৈতিক, সামাজিক ও বিদ্যায়তনিক পরিভাষা হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরচিতি দু’টি শব্দ। ভয়ের সংস্কৃতি হলো সমাজে নির্মিত বা তৈরি করা একটি মানসিক অবস্থা। এই অবস্থা ও পরিবেশ যখন প্রবল হয়ে উঠে তখন আমরা বলতে পারি একটি সমাজ ভয়ের সংস্কৃতি দ্বারা তাড়িত। ওই সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যই তখন হয়ে ওঠে ‘ভয়’। বাংলাদেশের সমাজে ‘ভয়’ নতুন কোন বিষয় নয়। এই নিবন্ধে বাংলাদেশী-আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা ‘ভয়ের সংস্কৃতি বাংলাদেশে রাষ্ট্র, রাজনীতি সমাজ ও ব্যক্তিজীবন’ (প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, বাংলাদেশ ২০২১)’র পাঠ-মূল্যায়ন করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। ১৯৯৪ সালে বইটির প্রাথমিক ভাষ্যে লেখক যেসব লক্ষণরেখা দেখে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেহারা কল্পনা করেছেন, তার কতটুকু আজকের বাংলাদেশে এসে দৃশ্যমানভাবে প্রমাণিত তা মূল্যায়ন করতে গিয়ে এই প্রবন্ধ। এছাড়াও সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বেশ কিছু ইস্যুতে আমরা সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি প্রপঞ্চটি উচ্চারণ হতে দেখছি নানা পরিসরে। এখানে ভয়ের সংস্কৃতির মাত্রা ও পরিসর নিয়ে অনেক কথাবার্তা চলছে। ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ শব্দদয় এখন বহুল উচ্চারিত একটি প্রপঞ্চ। প্রবন্ধের শেষাংশে বেশ কিছু উদ্ধৃতির সন্নিবেশ করা হয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে বইটি যে কেবল মলাটবন্দী বায়বীয় সাদা কাগজের অক্ষরের সমষ্টি, তা নয়; বরং বইটি বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজদেহের জন্য বহুলাংশে প্রসঙ্গিক।
২০২২ সালে চলতি বইমেলায় বইটির তৃতীয় মুদ্রণ পাঠকের হাতে এসেছে। ২০১৪ সালে বইটি প্রকাশ করে প্রথমা প্রকাশন। এর আগে যদিও ১৯৯৪ সালে বইটির একটি ভাষ্য মুদ্রিত ছিলো, কিন্তু ক্রমাগত পাঠক চাহিদা ও দীর্ঘসময় বইটির অনুপস্থিতি (আউট অফ প্রিন্ট) রাজনৈতিক যোগাযোগভাষ্যকার ও গবেষকদের কাছে শিরোপীড়ার কারণ ছিলো। সেই ১৯৯৪’র পর ২০১৪ ও ২০১৮ এরপর সর্বশেষ ২০২১-এ বইটির মোট চারটি সংষ্করণ প্রকাশিত হলো। রাজনীতিবিজ্ঞান, যোগাযোগবিদ্যা, সমাজতত্ত্বসহ নানান বিদ্যায়তনিক পরিসরের বাংলাভাষী-বিদ্যোৎসাহীদের মধ্যে তুমুল আলোচনা ও উৎসাহের জন্ম দেয় বইটি। প্রথমা প্রকাশন বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এটির স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে দৈনিক প্রথম আলো। বইটি পাঠকমহলে সাড়া ফেলার অন্যতম কারণ, ২৮ বছর আগে ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ’ দেখতে পাওয়ার মতো লেখকের সুদূরপ্রসারী গবেষণা-ভাবনা। ভয়ের সংস্কৃতি নিয়ে বাংলা ভাষাতে এটি প্রথম কোন ‘মৌলিক’ বই যেখানে লেখক দ্ব্যর্তহীনভাবে বলেছেন ‘..ভয় গ্রাস করেছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ-জীবনকে। শাসনের ভিত্তি এবং সম্পর্কের ধরনের মধ্যেই রয়েছে জবরদস্তি, বলপ্রয়োগ ও ভীতির সঞ্চার’।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. আকবর আলি খান লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাত চারটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে: ১) ঐতিহাসিক ২) সমাজতাত্ত্বিক ৩) সাংবিধানিক ও ৪) নিবিড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ (যা অর্থনীতিতে ক্রীড়া তত্ত্ব বা game theory রূপে পরিচিত।’’ [খান, আকবর আলি (২০১১); অন্ধকারের উৎস হতে: সাহিত্য, সমাজ, পরিবেশ ও অর্থনীতি সম্পর্কে আলোর সন্ধান, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, পৃষ্ঠা নং ১০৮] আকবর আলি খানের রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সূচকগুলোর মিল খুঁজে পাই আমরা আলী রীয়াজের বইতেও। আলী রীয়াজ তাঁর বইতে বাংলাদেশের ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তারের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক সংঘাতকে দায়ী করছেন। তিনি ১০টি অধ্যায়ে চমৎকারভাবে তুলে ধরছেন পুরো বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার সংকট। বইটিতে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজদেহে ভয়ের সংস্কৃতির উৎস খুঁজেছেন এবং সর্বগ্রাসী সেই প্রবণতা থেকে মুক্ত হওয়ারও পথনির্দেশ করেছেন। ২০২২ সালের বাংলাদেশে বসে বইটির নির্মোহ মূল্যায়নে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রার প্রবল প্রতিবন্ধক হিসেবে আছে ভয়ের সংস্কৃতি।
বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে তিনি ভয়ের সংস্কৃতির সংজ্ঞা, স্মারক ও বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন। একেবারে প্রাথমিক ও আগ্রহী পাঠকের কাছে তা প্রথম সোপানের মতো। এরপর ক্রমান্বয়ে তিনি দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘ভাবাদর্শের জাল’, তৃতীয় অধ্যায়ে এসে ‘ভয়ের সংস্কৃতির রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। যে অধ্যায়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ থেকে সংকটের সূত্রপাত করেছেন। চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি আলোকপাত করেছেন, ‘অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ার’ নিয়ে। পঞ্চম অধ্যায়ের আলোচনার বিষয়- ‘প্রান্তিকতা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্টী’। ষষ্ট অধ্যায়ে তিনি বর্ণনা করেছেন ‘অনস্তিত্বশীল আদিবাসী জনগোষ্টী’ শিরোনামে বিশদ এক ব্যাখ্যা। সপ্তম অধ্যায়ে ‘নারী ও অধস্তনতা’, অষ্টম অধ্যায়ে ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনিশ্চিত জীবন’, নবম অধ্যায়ে ‘ফতোয়া ও সালিসের রাজনীতি’ অধ্যায়ে তিনি সমাজে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ক্রমপ্রাসরমানতা নিয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন সমাজে রাজনৈতিক ও সামাজিক ইসলামের ব্যবহার। সর্বশেষ অর্থাৎ দশম অধ্যায়ে তিনি সংকটের সমাধানও টেনেছেন। উপসংহারে এসে তিনি বলেছেন ভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হওয়ার পথ কী।
২০২২ সালের বাংলাদেশে ‘যেকোন সময়’ ‘যেকোন কিছু’ ঘটতে পারে এমন আতঙ্কই আজ বাংলাদেশের সমাজকে গ্রাস করেছে। অর্থাৎ আলী রীয়াজের আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছি বর্তমান সংকটের মধ্যে। বইটির রচনাকালে (১৯৯৪ সালে) লেখক একটি নির্বিকার ও ভয়াবহ সমাজের ভবিষ্যদবাণী করেছেন। তিনি আশঙ্কা করেছেন সমাজে অধস্তন বা ভিন্নমতের উপর প্রবলের বলপ্রয়োগ বৃদ্ধি পাবে এবং সমাজে বাড়বে অসহিষ্ণুতা। বর্তমান সমাজে দাঁড়িয়ে এসব পূর্বাভাষের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি, সমাজে আইনি পথে মত প্রকাশ যেমন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি আইন বহির্ভূত হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার, গণপিটুনি ইত্যকার সহিংসতাও সহজলভ্য হয়ে উঠছে। এসব লক্ষণরেখা আমাদেরকে স্পষ্টত দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকালের ভেতর যাত্রা করেছে। এরকম একটি বিরলভাষ্য এবং তার অব্যর্থ সত্যভাষণ কিছুটা হলেও মানুষের মননজগতে প্রশ্ন ও কৌতুহল তৈরি করেছে। উক্ত বইটিকে আরো বহুস্তরায়িত পাঠের সুযোগ ও পরিচিতি দিতে সহায়ক হতে পারে। এ ধরণের গবেণষণাকর্ম আগামী দিনের রাজনৈতিক সত্যানুসন্ধানী ভাষ্য তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশের সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে ভয় ও আতঙ্কের প্রাবল্য অনুধাবন করার ক্ষেত্রেও বইটি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।
আমি যোগাযোগবিদ্যার শিক্ষার্থী। সমাজের রাজনৈতিক যোগাযোগ আমাকে ভাবিত করে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও সামাজিক সংকট আমার চিন্তা ও তৎপরতার একটি জায়গাজুড়ে রয়েছে কোনো না কোনো বই। আমার নয় বছরের অধ্যাপনা ও পাঁচ বছরের উচ্চশিক্ষা জীবনে কিছু বই আমাকে আলোড়িত করেছে। আমার মধ্যে অনেক প্রশ্ন তৈরি করেছে, বেশকিছু প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছে। সামান্য যোগ্যতার সম্বলে উচ্চশিক্ষায় সেবা দিতে গিয়ে এমন বেশকিছু চিন্তা, কাজ ও তৎপরতার সান্নিধ্যে এসেছি যা আমাকে পরিণত চিন্তার অধিকারী হতে সহযোগিতা করেছে। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখনীয় হল এই বই- ‘ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি’। বইটি আমাদের সময়ের একটি ঐতিহাসিক দলিল। যাকে বলা যেতে পারে রাজনৈতিক পূর্বাভাষ তথা অব্যর্থ ভবিষ্যদবাণীর দলিল। কেন ভবিষ্যদবাণী বলছি, এবার সে প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশ সবসময় একটি সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মহান স্বাধীনতা অর্জনের পরও দেশটির ‘ইতিহাস’ সুখকর নয়। সন্ত্রাস, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড ক্রমাগত এই দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির অঙ্গ। এই যাত্রাটির শুরু এক দীর্ঘ সর্পিল, ভগ্ন, বন্ধুর পথে। যে যাত্রার পথ মসৃন নয়। ভয় আর আতঙ্ক এই জনপদের চক্রের আবর্তনের মতো ঘুরে ফিরে আসে। একটি সহিংস রক্ষপ্লাবি যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার পরও স্বাধীন দেশে সহিংসতার কম নেই, বরং তা বেড়েই চলেছে। এটি সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য ভীতি ও উদ্বেগের কারণ। আলোচ্য বইটি এই ভয়ের সংস্কৃতি নিয়ে বিশদ ও অনুপুঙ্খ আলোচনা হাজির করে।
বইটির মূলভাব- ভয় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির মৌলিক উপাদান। শাসক ও বিরোধী জোটের মধ্যে একটি আশঙ্ক্ষা দৃশ্যমান যে- আজ যে/যারা নিরাপদ, কাল সে/তারা পতিত হতে পারে চরম অনিশ্চয়তায়। এই অনিশ্চয়তার হাত ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠের নামে আধিপত্যের শাসনের দিকে চলে যাচ্ছে। আবার এটাও সত্য যে, উগ্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর এবং সমাজে তার প্রয়োগের ফলে সহিংসতার মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের শাসন কাঠামোতে অন্যতম দৃশ্যমান চরিত্র হচ্ছে ভয়। ভয়ের সংস্কৃতি কী? কিভাবে তা বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজদেহে বিকশিত হলো? এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলছেন- ‘বাংলাদেশে যে সংস্কৃতি নির্মীয়মান, ইতোমধ্যে নির্মিত ও প্রবলভাবে বিরাজমান আমরা তাকে বলতে পারি ভয়ের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হল সন্ত্রাস এবং আতঙ্ক। ভীতি উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মধ্যেই এই সংস্কৃতির সূচনা, বিকাশ ও স্থায়িত্ব। ভয়ের সংস্কৃতি হল এমন এক আবহাওয়া ও পরিবেশ যেখানে আতঙ্ক, সন্ত্রাস ও বল প্রয়োগ একাধারে ক্ষমতার/শাসনের একটি ধরন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের নির্ণায়ক। অর্থাৎ সমাজে উপস্থিত শ্রেণী, গোষ্ঠী, ব্যক্তি সমূহের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে জবরদস্তি, স্বেচ্ছাচারিতা’। [রীয়াজ, আলী; (২০১৪); ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি, প্রথমা প্রকাশন, পৃষ্ঠা নং ১১]
উপরিউক্ত সহিংসতার মূলকেন্দ্র হলো ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার যুদ্ধ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা, ভবন ধস, লঞ্চ ডুবির মতো ভয়াবহ সব আইনবিরুদ্ধ কার্যক্রম। দেশজুড়ে ধর্মান্ধ শক্তির আস্ফালনের পাশাপাশি ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটেছে মুক্তচিন্তার কণ্ঠস্বরকে। স্বাধীন মত প্রকাশের উপর নেমে আসছে কথিত ধর্মীয় অনুভূতির ধারালো অস্ত্র। সমাজে যখন বলপ্রয়োগ এবং আধিপত্যই হয়ে ওঠে স্বাভাবিক প্রবণতা, তখন মানুষ যুক্তি আর সহিষ্ণুতা ভুলে যায়। আইন ও বিচারব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে উত্তেজিত জনতা সম্মিলিতভাবে বিচার হাতে তুলে নেয়। শুরু হয় মব লিঞ্চিং বা গণপ্রহার। বাংলাদেশের সমাজে গণপিটুনি একটি ক্রমবর্ধমান সংস্কৃতি হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে। প্রাচীন মার্কিন সমাজে কৃষাঙ্গদের ওপর একদিন যেভাবে পপুলার হয়ে ওঠেছিলো উন্মত্ত জনতার আদালত। এসব ঘটনা জনগণের মধ্যে গভীরভাবে একটি ভাবনাকে প্রোথিত করছে, যার নাম ভয়ের সংস্কৃতি। মানুষ প্রতিবাদহীন অবস্থায় ভয়ের চাদরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। সমাজে গুম হওয়া মানুষরা যেমন ঠাঁই নিচ্ছে ‘নেই’ মানুষের তালিকায়, তেমনি অপরের গুম হওয়া দেখে আরো দশজন নীরব হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র কখনো কখনো অপার দায়মুক্তি ভোগ করছে। একজনকে হত্যা করা কিংবা একটি জনপদের মানুষকে শঙ্কিত করার মাধ্যমে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতির সূচনা। সমাজে যখন এই সংস্কৃতি প্রধান হয়ে ওঠে, তখন আমরা তাকে বলতে পারি ভয়ের সংস্কৃতি। বাংলাদেশে এখন সেই সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সমাজে ও রাজনীতিতে সেই প্রবণতা এতটাই প্রবল, এটা বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না যে সেটাই এখন সমাজ ও রাজনীতির প্রধান প্রবণতা। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজজীবনকে ভয় গ্রাস করেছে। মানুষ ‘চুপ’ করে থাকাকেই আপাত সমাধান বলে মেনে নিয়েছে। সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি কিভাবে প্রযুক্ত হয় তা বোঝার জন্য এটাই মনে রাখা যথেষ্ট যে, অব্যাহত পরিস্থিতি সমাজে একধরণের নির্বিকার দর্শকশ্রোতা তৈরি করছে। যারা নিজেরা আতঙ্কিত এবং সম্ভাব্য সন্ত্রাসী তৎপরতার আশঙ্কায় নিজেদের অসহায় ভাবতে শুরু করেন। তারা কার্যত্ নিষ্ক্রিয়। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ইস্যুতে আমরা সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি প্রপঞ্চটি উচ্চারণ হতে দেখছি নানা পরিসরে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতির মাত্রা ও পরিসর নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। ভয়ের সংস্কৃতি এখন বহুল উচ্চারিত একটি প্রপঞ্চ। প্রবন্ধের এই অংশে কয়েকটি উদ্ধৃতি পর্যবেক্ষণ করলে তা বোঝা সম্ভব।
১৪৪ পৃষ্ঠার এই বইটিতে লেখক ভয় নামক সর্বগ্রাসী এক প্রবণতার উৎস খুঁজেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বইটিতে তার অনুমানের স্বপক্ষে যেমন তথ্যনির্দেশ হাজির করেছেন, তেমনি আশঙ্খাগুলো জানিয়ে গেছেন অত্যন্ত মার্জিত কিন্তু ক্ষুরধার যুক্তিতে। শত শত রেফারেন্স দিয়ে দশটি অধ্যায়ে তিনি ভয়ের এই সংস্কৃতিকে বিশ্লেষণ করেছেন নয় শুধু, শেষ অধ্যায়ে গিয়ে জাতিকে ভয়মুক্ত হওয়ার পথও বাতলে দিয়েছেন। সমকালীন রাজনৈতিক-সমাজতাত্ত্বিক, চিন্তক, কর্মী ও সমাজ পরিচালকদের জন্য এটি একটি অবশ্যপাঠ্যগ্রন্থ। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির গভীরে গিয়ে যে অতলান্তিক সমস্যার সামগ্রিক দিক তিনি ভয় নামক প্রপঞ্চকে শ্রেণীবদ্ধ করে তুলে ধরেছেন, যা তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয়কে নতুনভাবে তুলে ধরে। মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মধ্য দিয়ে। লেখক বেঁচে থাকেন তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে। আর যদি হয় মৌলিক লেখা, তাহলে সেই লেখক অমরত্ব লাভ করেন সমাজে। ‘ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বইটি সেই উচ্চতার একটি মৌলিক প্রয়াস। প্রকাশের প্রায় দু’দশক পরেও ভয়ের সংস্কৃতি গ্রন্থের আশঙ্খা’র বাণী যে এখনও প্রাসঙ্গিক সেটা এক অর্থে ‘অব্যর্থ ভবিষ্যদবাণী’ হলেও বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট ‘উদ্বেগজনক’ও বটে।