বিদ্রোহের নতুন ভাষা: ২০১৮ – ২০২৪ || Gen-Z যুগের বাংলাদেশ

বিদ্রোহের নতুন ভাষা: ২০১৮ – ২০২৪ || Gen-Z যুগের বাংলাদেশ || যোগাযোগবিদ্যার আলোকে একটি বিশ্লেষণ

একটা কথা খুব স্পষ্টভাবে, কোনো ধানাই পানাই না করে, ইনিয়ে বিনিয়ে ত্যানা না পেঁচিয়ে সরাসরি বলে রাখি- কোটা সংস্কারের এই আন্দোলনে কেউই সরকার পরিবর্তন চায়নি। কেউই না। অর্থনীতি ও রাজনীতিবিদ্যায় একে বলে অর্থনীতিবাদী আন্দোলন বা সংস্কার কর্মসূচি। সবাই চেয়েছিল সরকারের মন-মানসিকতার পরিবর্তন। কিন্তু এখন আন্দোলন থেকে সরকার পরিবর্তনের কথা উচ্চারিত হচ্ছে কেন? কখন ও কেনো শিক্ষার্থীরা সরকারকে নামতে বললো?

যখন সরকার বা দল নিজেকে শিক্ষার্থীদের মন মেজাজ বুঝে নিজেদের আপডেট বা মডিফাই করতে অস্বীকার করল, তখন ওরা বলল- ‘গো হাসিনা’!

এরা কারা? এরা সেই প্রজন্ম, যারা ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে গেলেও ‘জিতবে এবার নৌকা’ ‘শেখ হাসিনার সালাম নিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন’ গানটি সাউন্ড সিস্টেমে বাজিয়ে উদ্দাম নাচতো!

গত তিন মাস আগেও বিভাগের দু’টি পিকনিকে আমার কাপ্তাই ও ফটিকছড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়। পিকনিকের গাড়িতে এরকম একটি দলের ভোটের রাজনীতির প্রচারণা গানটি বাজানো এবং তাতে নাচতে থাকা শিক্ষার্থীদের দেখে আমি কিছুটা অবাক হই। কারণ, একটি বিভাগে নানান দল-মতের শিক্ষক শিক্ষার্থী থাকে। আমার বিভাগেও তাই। আমাদের সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী সরকারের অনুগত বা সমর্থক নয়। কিন্তু বিভাগের প্রতিদিনকার নিত্য ছকবাধা রুটিনের বাইরে একদিনের আনন্দভ্রমণে ওরা মন খুলে গান গেয়েছে, নেচেছে, আনন্দ উল্লাস করেছে। আর আমি খুব মনযোগ দিয়ে খেয়াল করেছিলাম, তাঁদের আনন্দের ভাষা আর আমাদের প্রজন্মের ভাষা আকাশ পাতাল পার্থক্য।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রজীবনে (২০০৪-২০০৯) আমাদের বিভাগের পিকনিকে যদি এরকম রাজনৈতিক দলের ভোট চাওয়ার গান বাজানো হতো, হয় আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করতাম না হয় পিকনিক বয়কট করতাম কিংবা কেবলমাত্র তৎকালীন সময়ের শাসকের অনুগতদের জন্য পিকনিক পার্টি হিসেবে নিজেকে ইজ্জতের সাথে বিযুক্ত করতাম। কিন্তু ২০২৪ সালে আমার পিকনিকের বাসে প্রায় সব শিক্ষার্থী আওয়ামী লীগের এই ডিজে গানটিকে অত্যন্ত আনন্দের সাথে নিয়েছে। এর কারণ, এটার বিট, এর আরেকটি কারণ, এই গানে আছে প্রধানমন্ত্রীর ‘সালাম’ দেয়ার কথা, এই গানে আছে ‘উন্নয়নের শপথ’।

কিন্তু মাস তিনেক না যেতে সেই একই প্রধানমন্ত্রী যখন শিক্ষার্থীদের ‘তুই’ বলে অসংবেদনশীল ও অসতর্ক মন্তব্য করে বসেন, তখন ওই একই প্রজন্ম প্রধানমন্ত্রীকে ওয়ালাইকুমসালাম জানিয়ে চ্যালেঞ্জ দিয়ে দিলো! সালামের উত্তরে ছেলেমেয়েরা সালাম দিতে জানেন, জেদের উত্তরে ছেলেমেয়েরাও জেদ ধরতে জানে। রাজমাতা সত্যবতীর জেদের বসে মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়। এখানে তুমুল ধুন্ধুমার বেঁধে গেলো।

কেন এই ধুন্ধুমার কাণ্ড?

কেবল দুটো প্রজন্ম একটা একটার মন ও মেজাজকে রিড করতে না পারা। যোগাযোগবিদ্যার ভাষায় ‘কমিউনেকশন নয়েজ’।

যোগাযোগ প্রক্রিয়ার মধ্যে নয়েজ বা শোর থাকবেই। এই নয়েজ কার্যকর বা সফল যোগাযোগের পক্ষে একটি বাধা। তাই এই সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। চাইলে এই নয়েজকে সবসময় একেবারে দূর করা বা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব নয়; উল্লেখযোগ্য হারে একে কমিয়ে আনাই এর সমাধান। কিন্তু দেখা গেলো রাষ্ট্র যেমন অসংবেদশনলীর মন্তব্যে অটল থাকলো শিক্ষার্থীরাও তাঁদের সর্বোচ্চ বিদ্রোহ দেখিয়ে দিলো।

কিন্তু এটি বাংলাদেশের কি এই প্রথম?

এই আন্দোলনের পূর্বলক্ষণ দেখা গিয়েছিলো আজ থেকে ছয় বছর আগে, আজকের এই দিনে! ২৯শে জুলাই।

আজ সেই ঐতিহাসিক ২৯শে জুলাই! ২০১৮ সালের এই তারিখটি রাজনীতির ইতিহাসের বহুবর্ণিল, বহু ব্যঞ্জনাময়, বহুমুখী। আজকের এই দিনে সূচনা হয়েছিলো ২০১৮-র নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। আক্ষরিক অর্থে বাংলাদেশ সেদিন প্রবেশ করেছিলো সম্পূর্ণ নতুন ও আনকোরা এক প্রজন্মের হাতে, যার আন্তর্জালিক নাম- GEN-Z MOVEMENT যুগ!

বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত সংঘটিত এই আন্দোলন বা গণবিক্ষোভকে Gen-Z মুভমেন্টের সূচনা বলা যেতে পারে।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে যে প্রজন্ম সরকারের সাথে ফাইনাল খেলা খেলছে, ওরাই কিন্তু ২০১৮ সালে সেমিফাইনাল খেলেছিলো! ছয় বছর আগের ম্যাচ হিস্ট্রিতে ফিরে যাই তাহলে? কী বলছে পুরানো স্কোরকার্ড?

২০১৮ সালের অন্য দশটি সড়ক দুর্ঘটনার মতো ওই দুর্ঘটনাটিও একটি কিন্তু সেটি বিশেষ হয়ে উঠে দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে সাংবাদিকরা সেই ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী সভাপতি শাজাহান খানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি হাসিমুখে বলেন যে “ভারতের মহারাষ্ট্রে গাড়ি দুর্ঘটনায় ৩৩ জন মারা গেছেন। এখন সেখানে কী আমরা যেভাবে এগুলোকে নিয়ে কথা বলি, এগুলো কি ওখানে বলে?” তার সেই বক্তব্য দেশব্যাপী অত্যন্ত সমালোচিত হয় এবং আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা তার ক্ষমাপ্রার্থনা ও পদত্যাগের দাবি তোলে।

টানা আন্দোলনে ২রা আগস্ট সরকার সব স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করলেও সেদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটসহ দেশের ৪২টি জেলায় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। “উই ওয়ান্ট জাস্টিস”, “আমার ভাই কবরে, খুনী কেন বাহিরে” প্রভৃতি স্লোগানে ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে তারা সড়ক মুখরিত করে রাখে।

বিক্ষোভের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা শহরের ট্রাফিকও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। তারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে গাড়ি আটকে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস সনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে; লাইসেন্সহীন চালক ও চলার অনুপযোগী গাড়িসমূহ ধরে ট্রাফিক পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে ও তাদের মামলা নিতে বাধ্য করে।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় শাজাহান খান হাসিমুখে প্রতিক্রিয়া দেয়ার পর শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। অবশ্য সেজন্য তাঁকে দুঃখপ্রকাশও করতে হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা সেদিন কিন্তু একটা কথা খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলো- ‘রাস্তা আমাদের ঠিক করতে দিন’। আজ ওরা বলছে ‘রাষ্ট্র আমাদের দেখতে দিন’।

তাহলে আমরা কী দেখলাম? ২০১৮ থেকে ২০২৪; এই ছয় বছরে কিশোর বিদ্রোহীরা রাস্তা থেকে উঠে এসে সরাসরি রাষ্ট্রকেও সংস্কার করার ইচ্ছা পোষণ করছে। তাদের এই কামনা-বাসনার প্রতি অনেকের সমর্থন ও সংহতি ছাত্র আন্দোলনকে আর আন্দোলনে রাখেনি, হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ।

একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, ২০১৮ সালে স্কুল পড়ুয়া কিশোর বিদ্রোহীরা রাস্তা সংস্কারের দাবী নিয়ে সেই যে প্রতিবাদ করতে শিখেছিলো, তারা কিন্তু তা ভুলে যায়নি। ২০১৮ সালে যারা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছিলো, তারাই এখন রাষ্ট্রকে ঝাঁকুনি দিয়ে এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নিচ্ছে। ছয় বছরের ব্যবধানে দুটি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বয়স ৩০ এর কম। সারা পৃথিবীতেই এই বয়সীদের বলা হচ্ছে GEN-Z; এরা ভাইব্রেন্ট, এরা আলফা, এরা স্ফুলিঙ্গ, এরা সৃজনশীল আত্মঘাতী, এরা সোজাসাপটা কথা বলতে চায়। এরা চায় সম্মান। এরা চায় গুরুত্ব।

যোগাযোগবিদ্যার ভাষায় ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত যাঁদের জন্ম, তাঁরাই ‘জেন-জি’। জেন-জিদের বয়স এখন ১২ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। এরা এমন এক প্রজন্ম, যারা এই সহস্রাব্দের সঙ্গেই পৃথিবীতে এসেছে। এদের কোনো পার্টি অফিস নেই, কিন্তু এরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন। এরা ঘরে থেকেও দুনিয়ার খবর রাখে। ঘরে এদের শরীর বিশ্রামের রুমটা ছোট কিন্তু মননে এরা বেড়ে উঠেছে ইন্টারনেট সাম্রাজ্যে। এদের ভাষা মিলেনিয়াল লিঙ্গো, জেন জ়েড স্ল্যাং। এদের উত্তর প্রজন্ম, জেন ওয়াই বা মিলেনিয়ালদের জন্ম ’৮১-’৯৬-এর মধ্যে। পরের দশ বছরে যাদের জন্ম, তারা জেন জি। জেন-জি হল মিলেনিয়াল জেনারেশনের পরের প্রজন্ম। মিলেনিয়াল জেনারেশনকে বলা হয়ে থাকে জেনারেশন ওয়াই। আর তাদের আগের প্রজন্মকে বলা হয় জেনারেশন এক্স। ব্রিটানিকা মতে, এরা আলফা, এদেরকে বলা হয়- Generation Z is succeeded by Generation Alpha, the first generation to be assigned a Greek letter!

জেন-জি এর সবকিছু অনলাইনে। প্রযুক্তি, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া এদের স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল; সেখানেই নিয়ে বেড়ে ওঠে। পৃথিবীব্যাপী নতুন এক সাম্যবাদের জন্য লড়ছে এই প্রজন্ম। এরা সাম্য ব্যবস্থার ডাক দিচ্ছে অথচ এরা মার্কস, লেনিন, চে গেভারাকে রাজনৈতিকভাবে অনুসরণ করে না। এরা সাম্যবাদী বিপ্লবী অথচ এদের কোনো বিপ্লবী দল নেই। এদের আইকন কে? এদের আইকন জয় বাংলা কনসার্ট, এদের আইকন বিটিএস ব্যন্ডদল, এদের স্বপ্ন- কোনো এক স্বপ্নবাজ প্রফেসেরর নেতৃত্বে এরা ‘মানি হাইস্ট’ করে দেশ ছেড়ে পালাবে, এদের আইকন প্রফেসর ওয়াল্টার হোয়াইট, এদের আইকন এডওয়ার্ড স্নোডেন, এদের ক্যারিশাটিক লিডারের নাম জুলিয়ান এস্যাঞ্জ, এদের বিনোদন ওয়েব সিরিজ, এদের অবসর হুকাপ পার্টি, এরা চায় বন্ধনহীন ভালোবাসা, এরা যৌবন অপচয় করে ‘ফ্লিং’ হতে হতে নিজেদের সগর্বে ঘোষণা দেয় ‘ইনডিপেনডেন্ট’, আগের প্রজন্ম বলতো ‘তোমাকে গুনি না’ তারা সেটার নবায়ন করেছে তাদের নিজেদের ভাষায়- IDGAF (I Don’t Give a Fuck) যার প্রমিত বাংলা করলেই উত্তরপ্রজন্মের রাবিন্দ্রীক নৈতিকতা বলবে- গেল গেল! সমাজ থেকে নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ সব গেলো।

না। সমাজ থেকে আসলে কিছু যায়নি। পুরাতনরা বরং জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে না বলে, নতুনরা বিদ্রোহ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে এই ভাষায় কথা বলছে! আমাদের কাছে যা গালি, ওদের কাছে সেটা প্রতিবাদ। এরা তাই বিশ্বব্যাপী ‘সামাজিক ন্যায়বিচারের যোদ্ধা’ হিসাবে নিজেদের দাঁড় করাচ্ছে। প্রযুক্তির বিবর্তনে মানব জাতি কখনোই এত বড় রোলার কোস্টার ঝাঁকুনি খায়নি। এই নতুন প্রজন্ম জীবনের প্রথম দিক থেকেই ইন্টারনেট, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এবং মোবাইল সিস্টেমে ঢুকে পুরাতন নৈতিকতা, পুরাতন ধারা, পুরাতন মূল্যবোধ সব বদলে দিচ্ছে। হাইপারকগনেটিভ জেনারেশন একইসঙ্গে ভার্চুয়াল ও একচুয়েল জীবনকে টেনে নিয়ে যায়। জেনারেশন জেডদের রাজনৈতিক প্রতিবাদ তাই একদম বাচ্চা বয়স থেকে ইন্টারনেটকে ‍ঘিরেই হবে। তাই জেনারেশন জেডকে বলা হচ্ছে ইতিহাসে সবচেয়ে কনিষ্ঠ, সবচেয়ে নৃতাত্ত্বিক-বৈচিত্র্যময় এবং বৃহত্তম প্রজন্ম। এরা অন্যায় নিতে পারে না। এরা ঘরেও মা-বাবার সাথে বিদ্রোহ করে, ফলে রাস্তায় বিদ্রোহ এদের কাছে অভ্যাস!

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ওরা শাহজাহান খানের কুৎসিত হাসির প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলো, এবার ২০২৪ সালেও ওরাই প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে অসাবধানতাবশত “রাজাকারের নাতিপুতি” গালিতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

দুই আন্দোলনই ছিলো নিছক সংস্কার কর্মসূচি। কিন্তু এগুলোকে ‘প্রপার ডিল’ করতে না পারার ফলে এগুলো অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি থেকে ‘বৈপ্লবিক কর্মসূচি’র দিকে চলে যায়। সাধারণ রাগ-ক্ষোভ থেকে জন্ম নেয় বড় বড় বেদনা, আর বেদনার ভাষায় ওরা কথা বলে আবু সাঈদের মত বুক চিতিয়ে। ওরা তাই বলা শুরু করে ‘কোটা সংস্কার না হলে সরকারের সংস্কার দরকার’। ওরাই বলেছিলো- ‘সড়ক যদি পরিবর্তন না হয়, তবে রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করো’।

খুব সাধারণভাবে ভাবলে কি মনে হয়, আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ ও সরকারের শত্রু।

আসলেই কি এরা রাষ্ট্রের শত্রু? না। আসলে বিদ্যমান বুড়ো রাষ্ট্রের জন্য এদের মতো পরম মিত্র আর নেই। সময় এসেছে রাষ্ট্রকে এদেরকে সঠিকভাবে ডিল করার। আমরা যেন ভুলে না যাই, এই প্রজন্ম যেমন সৃজনশীল, তেমনি এই প্রজন্ম আত্মঘাতিও। পরিতাপের বিষয়, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এই জেনারেশনকে গত ছয় বছরেও বুঝতে পারেনি। জেন-জির সহজাত প্রবৃত্তি ‘সেন্ডো গেঞ্জি’ পরা বুড়ো রাষ্ট্র যেন বুঝতেই চাইছে না!

একটি ঘরে বুড়ো না থাকলে যেমন ঘরটি অভিভাবকহীন, তেমনি ওই ঘরে একটা চঞ্চল শিশু না থাকলে ঘরটি শূণ্য। আর যে ঘরে একজন বৃদ্ধ মানুষ শিশুকে মহব্বত করে, সেই ঘরকে বলা হয়- পরিপূর্ণ! যে ঘরে শিশু-কিশোর-যুব-বৃদ্ধ একসঙ্গে পরিবারযাপন করে, সে ঘরে শান্তি, সে ঘরে সৌন্দর্য, সে ঘরে স্থিতাবস্থা! সেই ঘর আলোকিত!

এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্র যারা চালাচ্ছে, তাঁরা সবাই নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পোড় খাওয়া নেতা-কর্মী। তাদের সময় গণআন্দোলনের চরিত্র ছিলো, মানুষ বিক্ষোভ করবে, সব রাজনৈতিক দল মিলে যুগপৎ কর্মসূচি দিবে, রাজনৈতিক পবির্তন হবে। হয়েছেও তাই!

কিন্তু আজকের কিশোর বিদ্রোহীরা তাদের বুকের বেদনা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার কাছে যায় না, তাদের বুকের মধ্যে পুষে থাকা ক্ষোভ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক জোট গঠন করে সরকার পতনের জন্য কর্মসূচি দেয় না। তাঁরা তাঁদের বুকটা আবু সাঈদের মতো টানটান করে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রকে বলে- I Don’t Give a Fuck!

বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও পরিবারে এখন তিনটি প্রজন্মের সংঘাত চলছে। এই তিনপ্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক, সবচেয়ে সৃজনশীল, সবচেয়ে বিপদগামী ও সবচেয়ে সুন্দর হলো কিশোর প্রজন্ম।

বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে বিদ্রোহের চরিত্র লক্ষণে এই অনিবার্য বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হবে। কিশোর বিদ্রোহীরুপি এই নতুন চরিত্র ও নতুন ভাষা বোঝার মতো মন চাই, শোনার মতো কান চাই! নয়তো বিপদ। কারণ এদেরকে বিপদগামী করা সহজ।

আমি যোগাযোগবিদ্যার শিক্ষক, যোগাযোগের সূত্র ধার করেই বলি- ‘যোগাযোগ প্রক্রিয়ার মধ্যে নয়েজ বা শোর থাকবেই। এই নয়েজ কার্যকর বা সফল যোগাযোগের পক্ষে একটি বাধা। এই সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। তবে এই নয়েজকে সবসময় একেবারে দূর করা বা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব নয়; উল্লেখযোগ্য হারে একে কমিয়ে আনাই এর সমাধান। যোগাযোগ যখন চলমান, তখন অডিয়েন্সের ফিডব্যাক (প্রতিক্রিয়া বা ফলাবর্তন) জানার চেষ্টা করা দরকার; এতে করে অডিয়েন্স কি বক্তার বক্তব্য বুঝতে পারছে কিনা অর্থাৎ যোগাযোগটি কি এখানে সঠিক বা সফল হচ্ছে কিনা, তা বোঝা সম্ভব। ফিডব্যাক পেলে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে কোনো নয়েজ হচ্ছে কিনা বা হলে তা কী ধরনের- সেটি যেমন বোঝা সম্ভব, তেমনি এর কার্যকর সমাধানও সম্ভব। ২০১৮ সালে যোগাযোগ বিঘ্নকে যদি আমলে নিয়ে ফিডব্যাক গ্রহণ করতাম আমরা, তাহলে ২০২৪ সালের বিপর্যয় এড়ানো যেতো বলে আমি মনে করি।

কিশোর বিদ্রোহীদের দমিয়ে আমরা কোনোভাবেই রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল রাখতে পারবো না। Gen-Z বা আলফা প্রজন্মকে দমন করতে গিয়ে ‘আগুনে ঘি’ ঢেলে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কথায় আছে, ‘অতি দর্পে হত লঙ্কা’। লেখার শেষে দুটো স্লোগান লিখলাম,

‘স্যান্ডো গেঞ্জির দিন শেষ
জেন-জি’র বাংলাদেশ!’

‘২৯শে জুলাই বারে বারে
জেন-জি লড়াই করে।’

====================
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
==================

লেখাটি ২৯শে জুলাই ২০২৪ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত