চাঁদের মাটি ছুঁয়েছে ভারত। ২৩ আগস্ট বুধবার সন্ধ্যায় ইসরোর চন্দ্রযান-৩ অভিযান সফল হয়। এই সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের মাটিতে মহাকাশযান নামানো দেশগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে ভারতের নাম। এর আগে কেবল আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের এই কৃতিত্ব রয়েছে। শুধু তাই নয়, আরও একটি ইতিহাস ছুঁয়েছে ইসরো। চাঁদের দক্ষিণ মেরু এত দিন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত ছিল। ভারতই প্রথম দেশ হিসাবে চন্দ্রের এই প্রান্তটিতে পা রাখল। চাঁদের ‘কুমেরু’ আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাই ভারতের। (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন)
ভারতের এই চন্দ্রজয়ের ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু, সমাজ সচেতন, বিদ্যোৎসাহী ও বিজ্ঞানপ্রিয় মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে আনন্দের খবর। একজন ভারতীয় নাগরিকের কাছে তা গর্বেরও। ভারতের সাথে প্রায় কাছাকাছি সময়েই রাশিয়াও ‘লুনা ২৫’ নামে চন্দ্রযান পাঠিয়েছিলো। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতেই ভারতের মহাকাশ যান চন্দ্রযান-৩ সফলভাবে নামার একদিন আগেই রাশিয়ার ‘লুনা ২৫’ নভোযান চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে। ফলে বুধবারের এ অভিযান সফল হওয়ায় চাঁদের ওই অংশে চন্দ্রযান পাঠানো প্রথম কোনো দেশ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিলো ভারত। রাশিয়ার ‘লুনা ২৫’ নভোযানেরও চাঁদের এই মেরুতে নামার কথা ছিল। কিন্তু রোববার সেটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়।
পৃথিবীর দুই পরাশক্তি ভারত ও রাশিয়া। একই সময়ে চন্দ্রাভিযানের লক্ষ্য নিয়ে মহাকাশযানের যাত্রাকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গটি সামনে আসছিল। চন্দ্রযান দুটির অবতরণের সময়ও ছিল একই সপ্তাহেই। ফলে সবারই কৌতূহল, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে কারা আগে নামছে? রুশ নভোযানটি বিধ্বস্ত হওয়ার খবরটি মর্মান্তিক। বিজ্ঞানপ্রেমী যেকোন মানুষ তাতে মন খারাপ করবেন। কারণ এটি সামগ্রিক মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চার একটি ব্যর্থতা হিসেবে থেকে গেলো। কিন্তু নিজ দেশের সফলতা উদযাপন করতে আরেকটি দেশের ব্যর্থতাকেও কি উদযাপন করা যায়?
কমিউনিকেশন স্টাডিজে আমরা সিমপ্যাথি ও এমপ্যাথি বলে দুটি শব্দের প্রচলন দেখি। যার অর্থ হলো সহানুভূতি ও সমানুভূতি। আশ্চর্যের বিষয় হলো ভারতীয় গণমাধ্যম উগ্র জাতীয়তাবাদকে চাঙা করতে গিয়ে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণার ফলকে কেবল তুচ্ছ তাচ্ছিলই করলো না, রীতিমতো অবজ্ঞাও করেছে। আমাদের বন্ধুমহলে অন্তরে বিষ নিয়ে পাশাপাশি চললে আমরা তাকে বলি টক্সিক! ভারতীয় গণমাধ্যমও রাশিয়ার দুর্ঘটনাকে টক্সিসিটি সাংবাদিকতা করেছে। তারা এমনভাবে হেডলাইন বা শিরোনাম সাজিয়েছে যা ভারতীয় জাত্যাভিমান প্রকাশের পাশাপাশি রাশিয়ার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শনের নামান্তর। কথা না বাড়িয়ে এবার সরাসরি দেখে আসি কেমন ছিলো সেই সব শিরোনাম ও সংবাদের উপস্থাপন?
এইসময় পত্রিকার অনলাইন ভার্সন সংবাদ শিরোনাম করেছে-
চাঁদ দৌড়ে রামধাক্কায় পা জড়িয়ে আছাড়! লুনা ২৫ বিপর্যয়ে মুখ খুলল রাশিয়া
এইসময়ের অপর একটি খবরের শিরোনাম এরকম-
চিনকে বন্ধু ভাবাই কাল! বেজিংয়ের বাজে মালে তৈরি বলে ভাঙল রুশ ল্যান্ডার লুনা ২৫?
এইসময়ের আরো একটি খবরের শিরোনাম-
চোঁ চাঁ দৌড়তে দৌড়তে চাঁদের বুকে ভাঙল রুশ ল্যান্ডার, লুনা ২৫ খেল খতম!
হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা অনলাইনের শিরোনাম-
চাঁদে আছড়ে পড়ল রাশিয়ার লুনা-২৫, এবার দুনিয়ার একমাত্র ভরসা ভারতের চন্দ্রযান-৩!
দি ওয়াল পোর্টালের শিরোনাম-
ডিগবাজি খেয়ে চাঁদে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল লুনা-২৫, শর্টকাটে যেতে গিয়েই মহাকাশে সমাধি
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদ শিরোনাম করেছে-
ভারতকে টেক্কা দিতে চাঁদের পথে রাশিয়াও, শুক্রে রওনা দিয়ে চন্দ্রযানকে পিছনে ফেলতে চায় লুনা
এবিপি আনন্দ স্ক্রল শিরোনাম করেছে রাশিয়ার স্বপ্নভঙ্গ, চাঁদের মাটি ছোঁয়ার আগেই ভেঙে পড়ল লুনা-২৫, তারা টিভি রিপোর্টে ব্রেকিং দিয়েছে
উপরের শিরোনামগুলো কোনো অর্থেই নৈর্ব্যক্তিক নয়। এখানে ভারতের চন্দ্রজয়ের চেয়েও রাশিয়ায় চন্দ্রাহত হওয়াটাই বিরাট উদযাপনের। মনে হয়, সেদিন ভারতীয় সংবাদ ব্যবস্থানা বা বার্তা কক্ষ দারুণ মজা নিয়েছে এই দুর্ঘটনায়। কিন্তু আমরা জানি- সংবাদ মাধ্যম তার পাঠককে ক্রেডিবল ইনফরমেশন দিবে। সেটিই তার প্রধান কাজ। অথচ ভারতীয় উগ্র জাতীয়তাবাদের মোড়কে এমন সব শিরোনাম আমরা দেখলাম, যাতে মনে হলো এ যেন রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে চাঁদ দখলের প্রতিযোগিতা। যেন ক্লাসরুমের দরজা খুলে দেয়ার পর বলশালী কোন শিক্ষার্থী প্রথম বেঞ্চে বসতে পারলো এবং সহপাঠি আছড়ে খেয়ে পড়ে দরজার চৌকাঠে পড়ে যাওয়াতে সে বিমলানন্দ অনুভব করেছে।
কেন এই জাতীয়তাবাদী গর্ব? আমরা তো জানি- কখনো কখনো গর্ব-ই হয়ে পড়ে আমাদের কাছে অহঙ্কারের প্রতিরূপ। কবি মাইকেল মধুসূদন বলছেন- ‘আশার কুহক-ছলে!’ কবি নবীনচন্দ্র সেন পলাশীর যুদ্ধের পরাজয় বেদনাভরা মন নিয়ে লিখলেন- ‘ধন্য আশা কুহকিনী’। কথায় আছে-‘অতি আশা নিষ্ফল’। এই বঙ্গের গায়ক গেয়েছেন- ‘কী আশায় বাধিঁ খেলাঘর, বেদনার বালুচরে’। কখনো হতাশ প্রেমিকের উদাস মনে সুর ওঠে-‘বেশি কিছু আশা করা ভুল বুঝলাম আমি এতদিনে’। নৈরাশ্যবাদীরা বলেন- ‘আশা সে তো মরিচীকা’। তবুও আমরা আশা দেখি। তাতে জল ঢেলে দেয় গণমাধ্যম। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটলো।
মহাকাশ থেকে ফিরে আসি মহাভারতে। মহাভারত মিথলজির মহানায়ক যুধিষ্ঠিরের ‘গর্ব’ আর ‘অহংকার’ ছিলো তাঁর ‘ধর্মের আকাঙ্ক্ষা’। ধর্মের আকাঙ্ক্ষার উপর এমনই তাঁর অহংকার, এমনই তাঁর গর্ব যে- শকুনির চালে পাশা খেলায় ছল হচ্ছে জেনেও যুধিষ্ঠির নিজের স্ত্রী দ্রৌপদী আর পাণ্ডব ভাইদের পণ রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন! স্বাভাবিকভাবে আমরা প্রশ্ন করি- এ কেমন আকাঙ্ক্ষা? এ কেমন পরম্পরা? এ কেমন ধর্মের গর্বে গর্বিত হওয়া? আমরা দেখেছি, ধর্মের অহংকারে বলীয়ান যুধিষ্ঠিরের জন্যই স্ত্রী-ভাই-মা সবাই বছরের পর বছর কষ্ট পেয়েছে। ধর্ম নামক যে আকাঙ্ক্ষার জন্য যুধিষ্ঠির গর্ব করতেন, সেই ধর্মই সারাজীবন তাঁর উপর হয়ে পড়লো বোঝা।
আমরা কি জানি, আমাদের গর্ব আর অহংকারগুলোই একসময় আমাদের উপর বোঝা হয়ে পড়ে? বোঝা কিন্তু নিজে চলতে পারে না, তাকে বয়ে নিতে হয় সারাজীবন। মহাভারতের বাস্তবানুগ শিক্ষা এই যে, যুধিষ্ঠির একজন ধর্মের ভারবাহী ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ। ভারতীয় গণমাধ্যমের শিরোনামগুলো ভারতের চন্দ্রবিজয় উদযাপনের মধ্যেও নিজেদের হীনম্মন্যতা ও কপটতার নজির স্থাপন করলো। যে বেচারা চাঁদকে নিয়ে দুই পরাশক্তির এমন প্রতিযোগিতা, সেই চাঁদের যদি জবান থাকতো, তবে হয়তো গেয়ে উঠতো- দ্রুম দ্রুম চাঁদ, ঝকমকে হেডিং.. এই মাধবী রাত!
নিকট ভবিষ্যতে মানব বসতি স্থাপন করার জন্য চাঁদের দক্ষিণ মেরু সুবিধাজনক স্থান। ২০৩০ সালের মধ্যে সেখানে মানুষের বসতি স্থাপনের কথা ভাবছে চীন । এছাড়া চাঁদে অনেক মূল্যবান খনিজ পাওয়া যায়। এর একটি হল হিলিয়াম-৩, যা আমাদের আমাদের দূষণমুক্ত বিদ্যুৎ তৈরিতে সাহায্য করতে পারে। সুতরাং চাঁদকে নিয়ে চিন-ভারত-রাশিয়া এই পরাশক্তি ও পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যকার লড়াইয়ে সেসব দেশের গরিব, মধ্যবিত্ত, মেহনতি, মধ্যবিত্তের কী যাবে আসবে তা সময়ই বলে দিবে।