‘জিম্মি’: আধা রাজনৈতিক থ্রিলার, আধা ব্ল্যাক কমেডি— যোগাযোগবিদ্যার প্রেক্ষিতে অতি নাটকীয়তা আর বাস্তবতা
আশফাক নিপুনের সাত পর্বের ওয়েব সিরিজ ‘জিম্মি’ রাজনৈতিক থ্রিলারের ছদ্মবেশে যে গল্প তুলে ধরেছে, তা কেবল একটি অতিনাটকীয় এবং বিভ্রান্তিকর চিত্রায়ন ছাড়া আর কিছুই নয়। সিরিজের প্রধান চরিত্র রুনা লায়লা (জয়া আহসান)—একটি সাধারণ সরকারি চাকরিজীবী, যার জীবন অদ্ভুত এক মোড় নেয় যখন সে সরকারি অফিসে একটি টাকা ভর্তি লুকানো বাক্স খুঁজে পায়। লোভ এবং আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে সেই বাক্সটি নিয়ে নেয়ার পর রুনার জীবন একের পর এক বিপদের মুখে পড়তে থাকে। গল্পের ভিত্তি এটি হলেও, সিরিজটি তার রাজনৈতিক এবং সামাজিক বার্তাকে এড়িয়ে এক ধরনের সস্তা থ্রিলারের দিকে চলে গেছে, যেখানে রাজনৈতিক বাস্তবতা আর নাটকীয়তা একত্রিত হতে গিয়ে একটি বিভ্রান্তিকর মিশ্রণে পরিণত হয়েছে।
রাজনৈতিক থ্রিলার কিংবা ব্ল্যাক কমেডি?
‘জিম্মি’ রাজনৈতিক থ্রিলার হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু গল্পের গতিবিধি এতটাই এলোমেলো যে সিরিজটি শেষ পর্যন্ত এক ধরনের ব্ল্যাক কমেডি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সরকারি বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঘুষ কেলেঙ্কারি, ছাত্র আন্দোলন, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা—এই গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তব রাজনীতির বিষয়গুলো সিরিজে অন্তর্ভুক্ত হলেও, সেগুলোকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা হয়নি। একদিকে, এই সিরিজের কাহিনী রাজনৈতিক বিভ্রান্তি, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অন্দরমহলকে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা করেছে, তবে দ্বিতীয় দিক থেকে, চরিত্রগুলো এবং ঘটনাপ্রবাহ এতটাই কৃত্রিম যে, বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে তা কেবল মজাদার নাটকীয়তায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
রুনা লায়লার হারমোনিয়ামের ভেতরে লুকানো সেই টাকার অন্বেষণ, যা সিরিজের শেষ পর্যন্ত তার উদ্ধারকৃত অর্থের মাধ্যমে শেষ হয়, এক ধরনের ‘সস্তা উপসংহার’ সৃষ্টি করে। এ ধরনের নাটকীয় সমাধান কেবল দর্শকদের প্রতারিত করে, এবং সিরিজটির সৃজনশীলতার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সিরিজের চরিত্র রুনা লায়লার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রামকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়নি, বরং চরিত্রটি হয়ে পড়েছে অতিনাটকীয় এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন।
বিভ্রান্ত রাজনৈতিক বার্তা: লাসওয়েলের মডেল প্রয়োগ
এছাড়া, সিরিজে যে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটি অত্যন্ত অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকর। হ্যারল্ড লাসওয়েলের যোগাযোগ মডেল—“Who says what to whom in which channel with what effect”—এটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বার্তাদাতার কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট, এবং বার্তাটির প্রভাব প্রায় শূন্য। নির্মাতা কী বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, সেটি পরিষ্কার নয়। রাজনৈতিক শক্তি, দুর্নীতি, এবং প্রতিরোধের যে উপাদানগুলো সিরিজে ছিল, সেগুলো আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করা হতে পারতো। কিন্তু সিরিজের লেখনী এতটাই সাবলীল ও কমপ্লেক্স যে, দর্শক বুঝে ওঠতে পারে না, এটি প্রকৃত প্রতিবাদী কনটেন্ট, না একটি কল্পিত থ্রিলার।
উপসংহার ও সীমাবদ্ধতা
‘জিম্মি’ আসলে রাজনৈতিক থ্রিলার এবং ব্ল্যাক কমেডির মাঝামাঝি একটি বিশৃঙ্খল কনটেন্ট। সিরিজটি শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সংশয়ের আশ্বাস দিয়ে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা শুধু মজাদার নাটকীয়তায় পরিণত হয়েছে। সিরিজের শেষ সস্তা উপসংহার এবং চরিত্র নির্মাণের দুর্বলতা দর্শকের কাছে এক বড় হতাশা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এটি রাজনৈতিক বা সামাজিক বাস্তবতার যে ফাঁকফোকরগুলো তুলে ধরার কথা, তা শেষ পর্যন্ত এক ধরনের কৃত্রিম, সেফ গল্পের মোড়ক হয়ে গেছে। সিরিজটি সাহসিকতার বদলে নিরাপদ, অপ্রয়োজনীয় নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছে, যার ফলে এটি তার উদ্দেশ্য এবং বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে।
আশফাক নিপুন পরিচালিত ওয়েব সিরিজ ‘জিম্মি’ খুবই বাজে হয়েছে। এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎ প্রকল্পে আওয়ামী লীগ সরকারকে ঘুষ দেয়া, চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন, জুলাই মাসে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা, ৫ তারিখ সরকার পতন ও ৮ তারিখ রেজিম চেঞ্জ অবলম্বনে তিনি এক অখাদ্য বানিয়েছেন।
আশফাক নিপুন এর আগে দুই পর্বের ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজে বাংলাদেশের রাজনীতি, ঢাকা ও পুলিশ কালচার তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। আলোচিত ওসি হারুন চরিত্রে মোশারফ করিম একাই সেগুলো টেনে নিয়েছিলেন। সে বিবেচনায় জিম্মি আমার কাছে একটুও ভালো লাগেনি।
জয়া আহসান সিরিজের একেবারে শেষে ডেইলি স্টারের রিপোর্টার জায়মা ইসলামের (এস আলমের দু্র্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক) ভূমিকা নিতে গেলেন বলে মনে হলো, যা খুবই সস্তা হয়েছে।
“জিম্মি” সিনেমাটি নিয়ে মোটাদাগে মন্তব্য করা হলে বলবো: জুলাই আন্দোলনকে একেবারে অযাচিতভাবে ওয়েব সিরিজে ঢোকানো হয়েছে, যেখানে নিপুন এই ইস্যুর উপর আরও প্রভাবশালী কাজ করতে পারতেন। সিনেমার গল্পের পেছনে অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত একজন মানুষের কাছ থেকে সব টাকা ফেরত আসার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে এবং প্রবল গণঅভ্যুত্থান ও লুটপাটের পর হারমোনিয়াম ফিরে পাওয়া একটি অপ্রত্যাশিত পরিণতি দেয়। আরও বেশি আপত্তিজনক বিষয় হলো, পরকীয়ার সঙ্গে যুক্ত চরিত্রগুলিকে মধুরভাবে সমাপ্ত করা, যা মূলত একটি নৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করে। তাছাড়া, কমেডির জন্য তিনটি চরিত্র (দুই মাস্তান ও এক দালাল) একটি একেবারে অপ্রয়োজনীয় এবং বোরিং প্রভাব তৈরি করেছে। ফলস্বরূপ, এটি মোটেও উপভোগ্য হয়নি, এবং আমার ব্যক্তিগত রেটিং ১০ এর মধ্যে ৩।
এভাবেই ‘জিম্মি’ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক থ্রিলারের বদলে কেবল একটি সস্তা, নাটকীয় ওয়েব সিরিজ হয়ে রয়ে গেছে, যা অন্তত রাজনৈতিক সমালোচনা কিংবা সৃজনশীল চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে এক বড় সুযোগ হারিয়েছে পরিচালক।