জাস্টিন ট্রুডোর রুপালী বিচ্ছেদের সংবাদ উপস্থাপন

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং স্ত্রী সোফি গ্রেগোয়ার ট্রুডো ১৮ বছরের বিয়ের পর বিচ্ছেদ হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরদিন সে দেশের অনেক বড় সংবাদপত্র বড় বড় শিরোনাম ছড়িয়েছে। কানাডার জনপ্রিয় ৯টি পত্রিকার ফ্রন্ট পেইজে বেশ বড়সর কাভারেজ পেয়েছে এই ঘটনা। এমনকি কানাডার সংবাদপত্রগুলো ‘SPLITSVILLE’ এবং ‘LIKE FHATER, LIKE SON’-এর মতো শিরোনামও ছাপায়!

ট্রুডো ও সোফি ২০০৫ সালে বিয়ে করেন। তাদের ৩ সন্তান আছে। সবচেয়ে বড় সন্তানের বয়স ১৫ বছর। রয়টার্স সূত্রে জানা যায়, এর আগে ট্রুডোর বাবা ও কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর ১৯৭৭ সালে তার স্ত্রী মার্গারেটের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। জাস্টিনের মতো তিনিও তখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৫ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী হন ট্রুডো। করোনাকালে এই সুদর্শন প্রধানমন্ত্রী তাঁর নতমুখী ব্যক্তিত্ব ও স্বাস্থ্যনীতির জন্য দ্রুতই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ টানেন এবং বিপুল জনপ্রিয়তা পান।

জাস্টিন ট্রুডো

Le Journal de Montréal পত্রিকার প্রথম পাতায় লোগো ভেঙ্গে উঠে গেছে ট্রুডো দম্পতি। এরা ব্যানার লিড করেছে SOPHIE ET JUSTIN C’EST FINI যার বাংলা অর্থ ‘সোফি এবং জাস্টিনের এটাই সমাপতন’। ব্রেক আপ বোঝাতে দু’জনের ছবির মাঝখানে গ্রাফিক্স ডিজাইনে ছবির জোড়া অংশকে ছিড়ে দেয়া হয়েছে।

Vancouver Sun এই যুগল দম্পতির ঘনিষ্ট মুহূর্তের চুম্বনরত বড় একটি বর্গাকার ছবিকে লিড করেছে। দ্বিতীয় প্রধান সংবাদ শিরোনাম করেছে তারা PM. WIFE SEPARATING! এদিকে Montreal Gazette পত্রিকাটি নামলিপির পাশেই এই যুগল দম্পতির বিবাহের পুরানো ছবিকে পত্রিকার সর্বোচ্চ সুমহান স্থানে ছাপিয়েছে। National Post পত্রিকার প্রথম পাতার এক তৃতীয়াংশজুড়ে রয়েছে একটি সপ্রতিভ যুগল দাম্পত্যের ছবি, যেখানে রাস্তায় হাঁটছেন তারা কিন্তু পরস্পরের হাত ধরে। তাদের ব্যানার লিড Grégoire-Trudeau has already moved out; যদিও এই প্রতিবেদনের পরেই প্রথম পাতার এঙ্কর অংশে মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপিয়েছে তারা- শিরোনাম- TRUDEAUS FAMILY MAN IMAGE NOW AT RISk! এদিকে TORONTO STAR পত্রিকার প্রথম পাতায় মন্তব্য প্রতিবেদনই ব্যানার লিড নিউজ, যার শিরোনাম- SEPARATE WAYS, সাথে আছে যথারীতি দুজনের একটি হাস্যোজ্জল অন্তরঙ্গ ছবি। OTTAWA SUN পত্রিকার পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে ছবি ও শিরোনাম- SPLIT OUT! অপরদিকে FREE PRESS পত্রিকার প্রথম পাতাটি কিছুটা ব্যতিক্রম। এখানে ট্রুডোটে খোঁচা দিয়ে দ্বিতীয় প্রধান শিরোনামের খবর করা হয়েছে LIKE FATHER LIKE SON: PM SPLIT WITH WIFE, সাথে ২০০৫ সালে বিবাহযাত্রার একটি ছবিও স্থান পেয়েছে! CALGARY SUN পত্রিকার প্রথম পাতাজুড়ে ট্রুডো দম্পতির পরস্পর নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা একটি ছবির সাথে কেবল একটি শব্দই প্রধান শিরোনাম হিসেবে স্থান পেয়েছে- SPLITTING! সর্বশেষ THE GLOBE AND MAIL পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে তুলনামূলক তেমন কোনো গুরুত্বই পায়নি। প্রথম পাতার চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ খবর (ছবিহীন) হিসেবে তারা শিরোনাম লিখেছে- Trudeau, wife separate after 18 years of marriage!

কানাডার নয়টি সংবাদপত্রের প্রথম পাতা দেখে এবং তাতে প্রতিবেদনের উপস্থাপনা দেখে এটাই প্রতীয়মান যে, কানাডার জনগণ যেমন তাঁদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর সাফল্যে আনন্দিত হয়েছিলো, তেমনি আবার এই খারাপ সময়ে তাঁরা সমব্যথী ও সহমর্মী!

রসিকজন যতই বলুক, সংসার চালানোর চেয়ে কানাডা চালানো সহজ কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, সম্পর্ক সবসময়ই রোলারকোস্টারের মতো! আপাত নিপাট ভদ্রলোক ও সুদর্শন প্রধানমন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিত্বগুণেই বিচ্ছেদের সংবাদকে আদিরসাত্মক রসায়নে মজতে দেননি।

বিচ্ছেদ কি সব সময়ই বেদনার? বিবাহবিচ্ছেদকে ব্যথা ও ব্যর্থতার পাল্লায় মাপতে অভ্যস্ত ভারতীয় উপমহাদেশ। বাঙালি সমাজও তাতে অভ্যস্ত। কিন্তু সমাজে একটি নূতন ধারার সূত্রপাত হচ্ছে, যার নাম রুপালি বিচ্ছেদ (সূত্র: সম্পাদকীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, রুপালি বিচ্ছেদ, ২৪ অক্টোবর ২০১৬)।

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ‘বেলাশেষে’ চলচ্চিত্রটিতে প্রবীণ গৃহকর্তা পুত্র-কন্যাদের সামনে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত জানানোর পর স্ত্রীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, ‘এতদিনে মুক্তি!’ সংলাপটি মনে করলেই অনেক চাপা বেদনা ভেসে উঠে। শান শওকত, যৌবন, রূপ, গুণ সব থাকার পরও বিচ্ছেদ হয়। দাম্পত্য সম্পর্ক যখন নিষ্প্রাণ অভ্যাসের দাসত্বে পরিণত হয়, আসলে তখনই সম্পর্কের মৃত্যুই ঘটে! কেউ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেয়, কেউ বা মরা সম্পর্ক কবর না দিয়ে মমি বানিয়ে রাখে পিরামিড সংসারে।

কানাডা রাষ্ট্র ও কানাডার সাংবাদিকতা এটা অন্তত বুঝেছে যে, সুদর্শন প্রধানমন্ত্রীর বিবাহকে যথাযথ সম্মান করতে হয় যেভাবে, বিবাহবিচ্ছেদকেও সমান সম্মান করতে হয়! এটি কেবল দায় নয়, সমাজ ও সাংবাদিকতার একটি ঐতিহাসিক রায়!

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক,
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: rajibnandy@cu.ac.bd

ছবিগুলোর সূত্র: ৩রা আগস্ট ২০২৩ তারিখের টুইটার পোস্ট।