করোনাকালে গোটা বিশ্বের সিনেপ্রেমী মানুষ নাকি ডুব দিয়েছে ওয়েব সিরিজে। নেটফ্লিক্স এবং অ্যামাজন অন্তত তাই বলছে। এর মধ্যে তুমুল আলোচনায় আছে দু’টি ওয়েবসিরিজ, যথা- La CaSa De PaPeL বা Money Heist এবং Breaking bad। যদিও সিরিজ দু’টি প্রচারিত হয় করোনা সংক্রমণের বহু আগেই। কিন্তু লকডাউনে মানুষের গৃহবন্দী জীবনে এই দু’টি ওয়েব সিরিজ কিছুটা হলেও বিনোদন দিয়েছে। সম্প্রতি আমি দু’টি ওয়েব সিরিজেই দেখে শেষ করেছি। সিরিজ দেখে শেষ করে রেশ থাকতে থাকতে দু’টি সিরিজের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ মাথায় দানা বাঁধছে। সেই ভাবনা শেয়ার করতেই ধারাবাহিক লেখার অবতারণা। আজ রইলো প্রথম পর্ব।
‘ব্রেকিং ব্যাড’ সিরিজটি সাম্প্রতিক লকডাউনে দেখছি, এখন শেষের পর্যায়ে আছি। ‘মানি হায়েস্ট’ দেখেছিলাম গত বছর (২০২০) লকডাউনে, করোনা সংক্রমণের শুরুতেই। দুই লকডাউনে দুই লম্বা সিরিজ (প্রায় ৯০ ঘণ্টা) শেষ করতে গিয়ে কিছুটা মিশ্র অনুভূতি হয়েছে। ‘ব্রেকিং ব্যাড’র শুরুতে মারাত্মক বোরড ছিলাম। কোন সাসপেন্স নেই, স্লো একটি কাহিনী। এমনকি ক্যারেক্টারগুলির মধ্যেও খুঁজে পাচ্ছিলাম না তেমন কোন ইউনিকনেস। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালে বসে আমেরিকার প্রত্যন্ত এক অঙ্গরাজ্যের কাহিনী এটি। শুধুমাত্র একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই আগায় এই সিরিজটি, ফলে কাহিনী যেন অহেতুক লম্বা হয়ে যায়। এমনকি এক-একটি দৃশ্যও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বড় ব্যাপ্তিজুড়ে দেখানো হয়েছে। ফলে যেখানে ৫০ মিনিটের এক একটি এপিসোড, সেটিকে ছেঁটে ১৫ মিনিট করা যেতো আর এটা হলেই সিজনে হয়তো গতি আসতো।
এই সিরজটিতে দেখা যায়, এক্সপেরিমেন্ট করতে করতেই আমেরিকার এক কেমিস্ট্রি প্রফেসর নিষিদ্ধ মাদক (মেথ) তৈরি করলেন। এমনকি ধীরে ধীরে তিনি সেই মাদকের বিজনেসেও জড়িয়ে পড়ছেন। মূল চরিত্রটির নাম ওয়াল্টার হোয়াইট, সাথে তার এক শিক্ষার্থী জেসি পিন্কম্যান। ৫টি সিজনে মোট ৬২টি পর্ব, প্রতি পর্ব ৫০ মিনিটের করে। আমার কাছে মনে প্রথম তিন সিজন পর্যন্ত মনে হয়েছে এটি ওভার হাইপ একটি সিরিজ। এমনকি আমার যেসব শিক্ষার্থী ও ফেসবুক বন্ধুরা আমাকে ব্রেকিং ব্যাড দেখতে উৎসাহ দিয়েছে, তাঁদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে দেখলাম ওরাও খুব অলস সময় কাটাতে ভালোবাসে, তাই আমার হাতে যেহেতু এখন কিছুটা অলস সময়; আমিও ডুব দিলাম এই সিরিজে।
প্রথম দুইটি সিজনে সৃজনশীল কিছু পাইনি আমি, বরং ‘মেথ’ বানানোর মতো বারবার একটি জিনিসকেই সামনে এনে সিকোয়েন্স বড় করা হয়েছে। আরো একটি বিষয় আমাকে খুব হতবাক করেছে, ‘অপরাধী’ ধরার এত নিত্য-নতুন কৌশল আমেরিকায়, সেখানে একজন কেমিস্ট্রির প্রফেসর দিনের পর দিন পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মেথ বানিয়ে পৃথিবীর মাদক ব্যবসার সমীকরণ বদলে দিচ্ছে, এটি কিছুটা বিরক্তিকর। কিন্তু চতুর্থ সিজনের পর আমার ধারণা ভুল হতে থাকে। একেবারে যাকে বলে নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে সিরিজে ডুব দিতে হয়। মাদকের চোরাগলি পেরিয়ে বৈশ্বিক মাদক ব্যবসার ভিত নাড়িয়ে দেয়া একটি কাহিনীর সাথে পরিচিত হই। একজন সাধারণ ছা-পোষা জীবনের শিক্ষক, যার একটি সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে সুখে জীবন কাটানোর কথা, তিনি কেন এই পথে গেলেন? প্রফেসর ওয়াল্টারের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়লে পুরো সিজনের গতিমুখ পাল্টে যায়। ‘যেকোন মূল্যে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে হবে’ এই ধারণাটি প্রফেসর ওয়াল্টারকে বদলে দিতে থাকে। এভাবেই চলতে থাকে সিরিজ। প্রফেসর ওয়াল্টারন হোয়াইটের সাথে জুড়ে থাকে গবেষণা সহকারী জেসি পিংকম্যান, ওয়াল্টারের স্ত্রী স্কাইলার হোয়াইট, শ্যালিকার স্বামী শ্রেডার (যিনি আবার স্থানীয় মাদক নির্মূল কেন্দ্রের পুলিশ অফিসার!), আইনজীবী সল গুডম্যান এবং মাদক সম্রাট গুস্তাভো ফ্রিং।
‘মানি হায়েস্ট’ সিরিজটি দেখার পর একবুক আশা নিয়ে ‘ব্রেকিং ব্যাড’ দেখলে কিছুটা আশাহতই হতে হবে। কারণ, মানি হায়েস্টে পারস্পরিক কমিউনিকেশন স্কিলগুলো আপনাকে স্ক্রিন থেকে ঘাড় ফেরাতে দিবে না, টানটান উত্তেজনা আপনাকে এপিসোড শেষ হতে আরেক এপিসোডে নিয়ে যাবে । কিন্তু ‘ব্রেকিং বেড’ দেখতে দেখতে আপনি অনায়াসে ঘরের আরো দশটি কাজ করতে পারবেন। মানি হায়েস্ট সিরিজটি পুরো দুইবার দেখেছি, মনে হচ্ছে এই সিরিজে বুদ্ধির খেলা, নেতৃত্ব, পারস্পরিক যোগাযোগ কৌশল, রোমান্স, ক্রিটিক্যাল থিংকিং, হিউমার সবকিছুর সন্নিবেশ রয়েছে। যা ব্রেকিং ব্যাডে আমি পাইনি। যদিও পাবো বলে কেউ আমাকে দোহাই দেয়নি বা পাওয়ার আশা করাটা বোকামি।
মানি হায়েস্ট সিরিজের মূল বক্তব্য- এক মাস্টার মাইন্ড প্রফেসর তার ৮ জন ছাত্র (সঙ্গী) নিয়ে দুর্ধষ দু’টি ডাকাতির অভিযান। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ডাকাতি। লুট হবে স্পেনের টাকশালের টাকা ও ব্যাংক অফ স্পেনের স্বর্ণ। যে প্রফেসরের মূল পরিকল্পনায় এই ডাকাতি নাম তার সের্গিও মারকিনা। সের্গিওর পর বার্লিন চরিত্রটির ক্ষিপ্রপ্তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সিরিজের মুখ্য চরিত্ররা যথাক্রমে: প্রফেসর, লিসবন, টোকিও, হেলসিঙ্কি, রিও, নাইরোবি, স্টকহোল্ম, গান্দিয়া, আর্তুরো এবং বার্লিন। রুদ্ধশ্বাস দুটি ডাকাতি; একটি স্পেনের টাকশালে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় টাকা চুরি এবং অপরটি হলো স্বর্ণ চুরি। স্পেনের রয়্যাল মিন্ট থেকে টাকা চুরি, যেন তেন অংক না, একে বারে ২.৪ বিলিয়ন নিয়ে পালিয়ে যাবে পুরো আট জনের দল! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সিরিজটি দেখতে দেখতে মনে হবে “ইশ ডাকাতরা যেন ঠিকঠাকভাবে চুরিটা করতে পারে।” ডাকাতির পুরো পরিকল্পনা প্রফেসরের হলেও তিনি নিজে কিন্তু ডাকাতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন না। বরং বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকে পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য এবং তিনি অবিশ্বাস্যভাবে সফলও হন!
মানি হয়েস্ট এবং ব্রেকিং ব্যাড, এই দু’টি সিরিজই দর্শকদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ ফেলে। সেটি হলো- দর্শক হিসেবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে বসলেও সিরিজে আপনি কোন না কোন ডাকাতের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়তে বাধ্য। প্রফেসর ওয়াল্টার যে মাদক বানাচ্ছে, আপনি তার প্রতি দুর্বল হতে বাধ্য। কারণ, তার মাদক সাম্রাজ্যে ঢোকার একটি মানবিক কাহিনী আছে পেছনে। ঠিক একইভাবে প্রফেসর সের্গিও মার্কিনা কেন এভাবে ব্যাংক লুটের মতো কল্পনাবিলাসী অপরাধে পা দিলো, তার পেছনেও রয়েছে ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিদীপ্ত মানবিক কাহিনী। দুই প্রফেসরই আমেরিকা ও স্পেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
মানি হায়েস্ট শুধুমাত্র ক্রাইম জঁরার সিরিজ নয়, বরং ক্রাইমের পরতে পরতে রোমাঞ্চকর দু’টি অভিযান আর বুদ্ধিদীপ্ত কয়েকটি লড়াইয়ের গল্প। যদিও প্রফেসর সের্গিও মার্কিনার বিপরীতে প্রফেসর ওয়াল্টারকে নিষ্প্রভ মনে হয়। ওয়াল্টার যেন কামলাকাটা দিন মজুরের মত পুরো সিরিজে মেথ বানানোর মতো একঘেয়ে কাজ করে যায় দিনের পর দিন! কিন্তু প্রফেসর সের্গিও মার্কিনা সবাইকে এক করে ফেলতো, তিনি দলগত প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিতো, ছিলেন যৌথতার বিশ্বাসী ছিলেন। একজন প্রফেসরের কি আসলেই তাই হওয়া উচিত? সমাজবিদ্যা বলছে, হ্যাঁ। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে একজন প্রফেসর তার গোপন টিম নিয়ে হৈচৈ ফেলে দিবেন। প্রফেসর যেমন তার দলের সকল সদস্যের জন্য মাস্টারপ্ল্যান ঠিক করে রাখবেন, তেমনি দলের সদস্যরাও তার নেতৃত্ব মেনে চলবে। কিন্তু সমাজবিদ্যা যেমন একজন প্রফেসরকে যুথবদ্ধ করে তুলে তেমনি রসায়ন বিদ্যা একজন প্রফেসরকে অন্তর্মুখী করে তুলবে। ল্যাবে মনযোগ দিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ডুব দেয়াই একজন বিজ্ঞানীর কাজ। তাই প্রফেসর সের্গিওকে দেখি আমরা বুদ্ধির কৌশল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাজপথে মানুষ নামিয়ে দিতে, বিপরীতে প্রফেসর ওয়াল্টারকে দেখি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি আরভি গাড়িকে চলমান ল্যাব-এ পরিণত করে সমাজ থেকে পালিয়ে বেড়াতে।
দুই প্রফেসরর অনেক অমিলের মধ্যে একটিই মিল পাওয়া যায়, তা হলো দুজনেই আত্মগোপনে থাকে পুরো সিরিজজুড়ে। প্রফেসর সের্গিও যেমন বলে- ‘যার হারাবার কিছু নেই, তার আছে জয় করার মতো দুনিয়া’ (ইতালির ফ্যাসিবাদ বিরোধী বামপন্থি আন্দোলনের পরিবারের সদস্য বলেই), তেমনি প্রফেসর ওয়াল্টারের শিক্ষা হলো এই ‘পরিবার সবার আগে’। দুই প্রফেসরই ঠিক কথা বলেন কিন্তু যেন একে অপরের বিপরীত শিক্ষা। তাই ওয়াল্টারকে আমরা একা হয়ে যেতে দেখি, আর সের্গিওকে দেখি সমাজে মিশে যেতে। পুরো মানি হায়েস্ট সিরিজে প্রফেসর সের্গিও মারকিনাকে দেখা যায় এমন একজন মানুষ হিসেবে যিনি নিঃসঙ্গতা ভয় পান, কিন্তু ব্রেকিং ব্যাডের প্রফেসর ওয়াল্টার সবসময় অন্তমুর্খি হয়ে থাকতে চান। সিরিজের চতুর্থ সিজন পর্যন্ত প্রফেসর সের্গিও মারকিনা টোকিওকে পেয়েছেন তার প্রিয় স্টুডেন্ট হিসেবে আর পুলিশ ইনসপেক্টর রাকেলকে পেলেন জীবনসঙ্গী হিসেবে। কিন্তু ওয়াল্টার? প্রফেসর ওয়ল্টারের মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে বিজ্ঞান অনুসন্ধানে মগ্নতার পরিণাম হিসেবে আসে ব্যক্তিজীবনে দুঃসহ একাকীত্ম, ডিভোর্স!
প্রফেসর সের্গিও এবং প্রফেসর ওয়াল্টার, একজন সমরবিদ্যা ও অপরজন রসায়নবিদ্যার পল্ডিত। এরা শুধু জিনিয়াস নয়, রীতিমতো মাস্টারমাইন্ড। রসায়ন আর সমরবিদ্যা নয়, একটি যুদ্ধের সম্ভাব্য সকল পরিণতি ঠাণ্ডা মাথায় সুচারুভাবে সামাল দিতে ওস্তাদ তাঁরা। রাষ্ট্রের ভিত নাড়িয়ে দেয়া দুটি সিনেমাটিক চরিত্র, বিশ্বের ওয়েবসিরিজ এবং টিভি সিরিয়ালের ইতিহাসে প্রভাববিস্তারকারী দুই চরিত্র।
‘ব্রেকিং ব্যাড’ সিরিজে আমরা দেখি আমেরিকার এক কেমিস্ট্রি প্রফেসর কিভাবে নিজেকে নিষিদ্ধ মাদক (মেথ) তৈরি ও বিজনেসে জড়ায়। এই সিরিজের মূল চরিত্র ওয়াল্টার হোয়াইট আর জেসি পিন্কম্যান। ৫টি সিজনে মোট ৬২টি পর্ব, শুরুর দিকের সিজনগুলো কিছুটা ধীরগতির হলেও ক্রমেই এই সিরিজটি রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠে। ওয়াল্টারের ছাপোষা জীবন বদলে যায় তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ার পর। আমরা দেখি, সিরিজের নায়ক প্রফেসর ওয়াল্টার আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনের মানুষ। তিনি কখনো মাদক সেবন করেন না। কিন্তু ভাগ্য বা রহস্যের জের ধরে তিনিই হয়ে উঠেন মাদক সামাজ্যের মাস্টার মাইন্ড। রসায়ন বিদ্যার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ও এক্সপেরিমেন্টাল কাজকর্মের অভ্যাস তাঁকে এই পথে ধাবিত করে। ফলে পেশীবহুল, তরুণ, খুল্লামখুলা না হয়েও তিনি ‘হ্যান্ডসাম’। পড়তি বয়সের এক আধবুড়ো হয়েও তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বের মুগ্ধতায় সবাইকে বশ করতে জানেন। পরিবারের প্রতি দায়, শিক্ষার্থীদের প্রতি নিবেদিত প্রাণ এবং প্রত্যুতপন্নিতা তাকে দিয়েছে এই চরিত্রের প্রতি আপামর দর্শকের ভালোবাসা। সিরিজে সিজন যত আগায়, শিক্ষক-ছাত্রের বন্ধন ক্রমাগত দৃঢ় হয়। পরষ্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তারা। তাঁদের সাথে যুক্ত হয় গুস্তাভ ফ্রিং। মাদক সম্রাটরা সাধারণত মানুষের ঘৃণা কুড়ালেও এই চরিত্রটি কুড়িয়েছে ভালোবাসা। এরকম একটি কুল ব্লাডেড ক্যারেক্টার সচরাচর পর্দাতেও খুব কম দেখা যায়। প্রফেসরের স্ত্রী স্কাইলার তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে সেপারেশনে গেলেও সমাজে স্বামীর মাদক ব্যবসা নিয়ে প্রকাশ্যে অভিযোগ আনতে পারছেন না, কারণ স্বামীর প্রতি মানবিক সহানুভূতি। জেসি পিঙ্কম্যান আগাগোড়া অস্থিরমতি ও দুষ্ট প্রকৃতির হলেও দর্শকদের চোখে তার অপরাধের চাইতেও অপরাধের জন্য এডভেঞ্চারপ্রবণ মনটিই হয়ে উঠে মুখ্য। জেসি যেন কিশোর বয়সী এক প্রাণোচ্ছ্বল আবেগী চরিত্র, স্কুল পালানো এক ব্যাকবেঞ্চারের প্রকৃত অভিভাবক হয়ে উঠতে দেখি প্রফেসর ওয়াল্টারকে। অথচ প্রফেসর এবং তার এই ছাত্রটির মাঝে সিরিজজুড়ে চলে তীব্র বাদানুবাদ, কখনো বা মারামারিও। কিন্তু দিন শেষে নদী যেমন সাগরে মিলে যায়, তেমনি ছাত্র-শিক্ষকের সৌহার্দ্য বন্ধনে দুজন থাকে আগাগোড়া বন্দী। সাময়িক লোভ, মোহ এবং স্বার্থ জেসিকে দূরে ঠেললেও ওয়াল্টার কখনো বেশি দূরে যেতে দেননি।
এসব চরিত্র আপাতত নেতিবাচক হলেও নেটজুড়ে দর্শকপ্রতিক্রিয়ায় দেখা যায় এরাই দর্শকদের ভালোবাসা বা সহানুভূতি কুড়িয়েছে। এর কারণ কী? কারণ, এরা পুরো সিরিজে নানান চিরিত্রের মধ্যে ভালো, তুলনামূলক ভালো, আরো ভালো, তার চেয়েও.. এরকম একটি সাইকেলের সাথে এরা আমাদের পরিচিত করায়। সিরিজে ভালো থেকে উত্তম চরিত্রগুলো ক্রমান্বয়ে আমাদের মুদ্ধ করে রাখে। খারাপ চরিত্রেরও মানবিক ও বুদ্ধিদীপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠে। ফলে যোগাযোগবিদ্যার ভাষায় চরিত্রগুলো আমাদের কাছে সহানুভূতি ও সমানুভূতি তৈরি করে নেয়। আমরা ভাবতে থাকি, ওই একই পরিস্থিতিতে থাকলে আমি কি করতাম?
‘ব্রেকিং ব্যাড’ কেবল ওয়াল্টার আর জেসি দুজনের মধ্যকার কারবার হলেও ‘মানি হাইস্ট’ হলো সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এখানে যুদ্ধ শুধুই রাষ্ট্র নামক বহির্শত্রুর সঙ্গে নয়, বরং সিরিজের প্রতিটি চরিত্র নিজের সঙ্গেও যুদ্ধ করে। দু’টি ডাকাতিকে ঘিরে চারটে সিজন। এই দু’টি ডাকাতিতে বন্ধুত্ব, শত্রুতা, মানসিক টানাপড়েন বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। এই সিরিজে টোকিওর অস্থিরমতির জন্য টোকিওকে দোষ দেয়া যাবে না, রিও’র সরলতার জন্য তাকে একটু সাবধান করতে ইচ্ছে করবে, নাইরোবির জন্য মায়া জন্মাবে, ডেনভারের বোকা হাসির জন্য দর্শকদের হাসি উঠবে, আর্তুরো আর গান্ধিয়াকে দর্শক ঘৃণা করবে। আর বার্লিন? সবাই চুরি করেছে টাকা, কিন্তু বার্লিন চুরি করে দর্শকদের মন। এরা সবাই বিপদে কাঁধে কাঁধ মেলায় কিন্তু একে অপরের দিকে বন্দুকও তাক করে। মানসিক দ্বন্দ্বকে ঘিরে ‘স্টকহোল্ম সিনড্রোম’ দেখানো হয় সূক্ষ্ম অনুভূতির মাধ্যমে। ফলে আশ্চর্য এক সহানুভূতি তৈরি হয় দর্শকদের মনে। যে প্রোফেসর তার পুরো টিমকে প্রেম না করার পরামর্শ দেয়, সেই যখন পুলিশ ইন্সপেক্টর রাকেলের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে, দর্শকমনে তৈরি হয় আরো একটি সহানুভূতি মন। প্রথম দুই সিজনে যাকে ঘৃণা করেছে দর্শক, শেষের দুই সিজনে তিনিই হয়ে উঠছেন ভালোবাসার ‘রাকেল’।
‘ব্রেকিং ব্যাড’ এবং ‘মানি হায়েস্ট’ দুই সিরিজেই দুই প্রফেসর ‘সিমপ্যাথি-এমপেথি ট্রাম্পকার্ড’ দিয়ে ভক্ত জুটিয়ে নেয়। ভক্তরা তাদের প্রফেসরদের মাদক রসায়নে মজে যায় বা সালভাদোর দালির মুখোশ পরে হাইস্টকে সমর্থন করে যায়। ব্রেকিং ব্যাডের মতো এই সিরিজের প্রফেসরও পেশীবহুল কোন তারকা নন। তিনিও ওয়াল্টারের মতো এক মাঝবয়েসী সাধারণ মানুষ। প্রয়াত পিতার অপূর্ণ ইচ্ছে পূরণ করতে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় চুরির দায় নেন তিনি। প্রফেসরের দল স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী সালভাদের দালির মুখোশকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলে। প্রফেসরের সের্গিও মার্কিনার মানবিক দিক হলো ব্যাংক ডাকাতি হবে কিন্তু কোন খুনাখুনি হবে না এমনকি আটকে পরা জিম্মিদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। অবশ্য প্রফেসরের ছাত্ররা ভালো ব্যবহারই নয় বরং বাড়তি হিসেবে প্রেমটুকুও করেছে! ডায়লগের দার্শনিক দিক যেমন আছে, আছে প্রতিটি চরিত্রের গভীরতা। সাসপেন্স, থ্রিলার, রোম্যান্স, উইটিনেস, ক্রাইম মিলে এই বহুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে এই ওয়েব সিরিজটি। দর্শকরা কেন ডাকাতদলকে সমর্থন করে? করে কারণ, কোন একটি কাজ বাস্তবায়নের জন্য কতটা নিঁখুত পরিকল্পনা দরকার আর সেই পরিকল্পনার জন্য কতটা ডেডিগেশন দরকার এই সিরিজে দেখতে পাওয়া যায়।
মানি হায়িস্ট সিরিজটির প্রথম সিজনে ১৩টি, দ্বিতীয় সিজনে ৯টি, তৃতীয় সিজনে ৮টি এবং চতুর্থ সিজনেও ৮টি পর্ব রয়েছে। সর্বমোট চারটে সিজন, আটত্রিশটা এপিসোড। এখন পঞ্চম তথা শেষ সিজনের শুটিং চলছে। গত দুই বছরে করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের লকডাউনে নেটফ্লিক্সের ওয়েব সিরিজে এই সিরিজটি সবার মুখে মুখে। গতবছর ‘প্রফেসরের কী পরিণতি’ এমন এক নাটকীয় প্রশ্ন রেখে পুলিশের গুলির মুখে গ্রেফতার হওয়ার দৃশ্যে শেষ হয় চতুর্থ সিজন। কিন্তু প্রফেসরের কপালে বন্দুক ঠেকানোই যেন কাল হলো, দর্শক সিম্প্যাথি আরো জোরালো হয়ে উঠলো যেন। দর্শক পুরো একবছরজুড়ে ভাবছে সম্ভাব্য পরিণতি। কখনো ভাঙ্গা মুখোশকে মনে করছে প্রফেসরসহ পুরো দল কী মারা যাবে? নাকি গ্রেপ্তার হবে? নাকি প্রথম ডাকাতির মতো প্রফেসর সফল হয়ে পালাতে পারবে সদলবলে? শেষ সিজন পর্যন্ত অপেক্ষায় কাটছে দর্শকদের, এসব উত্তরের শুটিং চলছে। প্রফেসর চরিত্রের আলভারো মর্তে ইনস্টাগ্রামে মাঝে মাঝে এমন কিছু ছবি পোস্ট করছেন, তাতে উন্মুখদশা তো কাটছে না, বরং মুগ্ধতা তৈরি করছে।
পুরো পৃথিবী এখন করোনা নামক অদৃশ্য অণুজীবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। সঙ্গরোধ গৃহবন্দীত্বে ‘ব্রেকিং ব্যাড’ এবং ‘মানি হায়েস্ট’ দুই সিরিজের ‘অ্যান্টিহিরো-সাগা’কে চিত্তাকর্ষক করে তুলছে ইন্টারনেট মাদকতা। এই মাদকতা এমন ভয়াবহ যে, প্রফেসর ওয়াল্টারের হতাশায় দর্শক যেমন মুষড়ে পড়েন, প্রফেসর সের্গিও মার্কিনার প্রতিরোধ ভেঙে গেলে দর্শকও চিন্তিত হয়। জেসি পিঙ্কম্যান যখন মার খেয়ে কাতরায় তখন দর্শকও ব্যথা পায়। নােইরোবি মারা গেলে চোখের জল প্লাবন নামে দর্শকদের। মহামারিতে পৃথিবী দেখলো দুই অভূতপূর্ব উন্মাদনা। ইন্টারনেট বিনোদনের বাজারে তাই এই দুটি সিরিজ আমেরিকা-স্পেন ছড়িয়ে এন্টিহিরো সিমপ্যাথি নিয়ে করোনা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এই দুই ওয়েব সিরিজ তৈরি করেছে বিনোদনের নয়া বিশ্বায়ন। যে বিনোদনে ‘ভালো’ নয়, ‘মন্দ’দের প্রতি তৈরি হয় এক অপার মানবিক অনুভূতি।