উন্নয়ন সাংবাদিকতা ও প্রশ্নবিদ্ধ প্রথম পাতার বিজ্ঞাপন

একটি সংবাদপত্র তার প্রথম পাতায় কতটুকু বিজ্ঞাপন ছাপবে- এটি পৃথিবীজুড়ে বিতর্কিত ও আলোচিত-সমালোচিত প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সুরাহা নেই। তবুও দেশ, কাল, পাঠক ও পরিস্থিতি ভেদে এই প্রশ্নের একটি উত্তর আমরা নিজেরাই ঠিক করে নিই। কিন্তু বিশ্বের কর্পোরেট সাংবাদিকতার ইতিহাসে আজ একটি অত্যুজ্জ্বল সমালোচিত দিন। ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বিজেপি সরকার একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় বিরাট বিজ্ঞাপন দিয়ে আজ ১২ই সেপ্টেম্বর চরম অস্বস্তিতে পড়েছে। যদিও আজ ভারতজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর দুপুরের দিকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা টুইট করে জানায় ভুলটা তাদের মার্কেটিং বিভাগেরই এবং তাদের সব ডিজিটাল সংস্করণ থেকেই বিজ্ঞাপনটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুঝতে বাকি থাকে না যে- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে চাপ দিয়েই এটা করানো হয়েছে। কারণ বিজেপি আজ পুরোপুরি ধরা খেয়ে গেছে! তাই ধরার পরার পর দোষ গিয়ে পড়লো খোদ পত্রিকার ওপর। পত্রিকাটি যে বৃষ্টি বিধৌত তুলসী পাতা, তা নয়। এখানে পত্রিকাটিরও শিক্ষা নেয়ার বিষয় রয়েছে। তা হলো- যোগী আদিত্যনাথ মাইনকা চিপায় পড়ার পর পত্রিকাটিকেই বিপদে ফেলতে চাইছে। কর্পোরেট সাংবাদিকতার এই দশাকে বলে ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ অবস্থা। সে আজ কূলহারা কলঙ্কিনী রাধা! রাতে পত্রিকাটি বিজেপির কাছ থেকে পয়সা পেয়েছে, দিনে পেলো ভৎসর্না।

.
একটি দেশের ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সে দেশের রুটিন কাজ। সেটা হওয়ার কথা, হবে- এটাই তো নিয়ম। সরকার পরিবর্তন হলেও উন্নয়নকাজগুলো চলার কথা। কিন্তু আমাদের হিশেব নিকেশ আলাদা। আমরা প্রায়শেই দেখছি, শাসক দলের রুটিন কাজ কখনো কখনো ‘ফলাও প্রচারণা’র বিষয়ে পরিণত হচ্ছে।

দেশের ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নকে জনগণের সামনে তুলে ধরাকে একসময় উন্নয়ন সাংবাদিকতা হিসেবে ভাবা হতো। কিন্তু সময় এসেছে, এ ধরণের কর্পোরেট সাংবাদিকতার নামে দলীয় প্রচারণা আসলে কতটুকু জায়েজ?

.
বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়েছে- ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিশাল ছবি সমেত যে রাজ্যের উন্নয়ন-সূচক যে ছবি ছাপা হয়েছে – তা আসলে কলকাতার একটি ফ্লাইওভারের ও স্কাইলাইনের।’ সরকার যখন এ ধরনের কোনও বিজ্ঞাপন দেয় সেটা এজেন্সির মাধ্যমেই দেওয়া হয়। প্রশ্ন উঠেছে সেই এজেন্সিকে নিয়েও। ভারতীয় শাসকদল বিজেপি এখানে নিজের অজান্তেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে একটা ‘স্বীকৃতি’ দিয়ে ফেলেছে!

.
ভারতের এই ঘটনা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় একটি শিক্ষা। কারণ, বাংলাদেশের কিছু কিছু সংবাদপত্রের উন্নয়ন গাঁথা এমনভাবে গাওয়া হয়, যেন সেটা আসমানি গায়েব। এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না, কিন্তু কারো রহমতে উন্নয়নের নহর বসেছে। ভারতের এই ঘটনার মতো বাংলাদেশেও হরহামেশা এই ধরণের বিষয় খেয়াল করা যাচ্ছে। বিশেষত, দেশের বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টে কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ও সে দলের প্রভাবশালী নেতার ‘সফলতা’ দাবী করে ফলাও প্রচারণা সংস্কৃতিতে মেতে উঠছি আমরা। ভারত ও বাংলাদেশের সংবাদপত্রের প্রথম পাতা কখনো কখনো কোনো না কোনো কোম্পানি বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থ রক্ষার প্রহরী হিসেবে কাজ করছে। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় এরকম অভাবনীয় বিজ্ঞাপন প্রকাশের ঘটনা কয়েকটি বিষয়কে সামনে নিয়ে আসছে-

১। ফুলপেইজ জ্যাকেট বিজ্ঞাপন ছাপানোর পর সেই পত্রিকা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারে কি?
২। একটি সংবাদপত্র প্রথম পাতায় কোন ধরণের বিজ্ঞাপন ছাপবে?
৩। শাসক দল চাইলেই সরকারি পয়সা তসরুপ করে এভাবে ফলাও প্রচার করতে পারে কি?
৪। একটি দেশের ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রচারণা কতটুকু ভব্যতা/শালীনতার মধ্যে করা উচিত?
৫। একটি দেশের ‘সরকার’ ও ‘রাজনৈতিক দল’র মধ্যে বেসিক পার্থক্য কী?
৬। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বিভাগে কতটুকু মিডিয়া লিটারেসি থাকবে?