২০০৮ সালের কথা। তখন চবির যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের থার্ড ইয়ারে পড়ি! ‘সরেজমিন রিপোর্ট’ কিভাবে করতে হয় ক্লাসে অল্প-বিস্তর শিখছি। সেই ভরসায় রিপোর্ট করতে একদিন চলে যাই একা একা চন্দনাইশ।
তখন আমি সমকালের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি। আমার কাজ চবির খবর চট্টগ্রাম ব্যুরো পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। কিন্তু চবির গণ্ডি ছাড়িয়ে কখনো শিল্পকলা, কখনো টিআইসির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং জাপান, মার্কিন ও ভারতীয় এম্বেসির বড় কর্তা এলে সেগুলোও কাভার করতাম। আমার সাংবাদিকতা জীবন শুরুই হয়েছে ভারতীয় দূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর চট্টগ্রাম সফরের একটি প্রোগ্রাম কাভার করতে। সে যাক, বেশি বললে ঢোল পেটানো হয়ে যাবে।
একদিন চবি থেকে ফেরার পথে চন্দনাইশে বাড়ি এমন এক সহপাঠী শ্লেষের সুরে বললো “খুব তো আহমদ ছফা পড়ো। বিরাট তাত্ত্বিক। খবর রাখো ওনার পরিবারের?” শাটল ট্রেনের ছাদে চুল উড়িয়ে ভাসছিলাম রোমান্টিক মুডে। খুব বেশি জোর দিইনি কথায়। ষোলশহর জংশনে ট্রেন থেকে নামতেই কথাগুলো খচখচ করলো বুকে। রাতে আমার আরো একটি সোর্স খবর দিলো আহমদ ছফার বাড়িঘর জায়গা জমি সব বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সোর্স অনেকসময় মিসগাইড করে। তাই খবরটি যাচাই করলাম তিনটি পৃথক সোর্স থেকে। নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে চলে যাই চন্দনাইশ। অফিস আমাকে আসা-যাওয়ার খরচ তো দেয়নি, উল্টো এই নিউজ প্রকাশের পর যে চাপ এসেছিলো, তাও সামলাতে হিমশিম খেয়েছিলো। একমাত্র চট্টগ্রাম অফিসের সিনিয়র সাব এডিটর ও আঞ্চলিক প্রকাশনা প্রিয় চট্টগ্রামের বিভাগীয় সম্পাদক হোসাইন তৌফিক ইফতেখার ভাই আমাকে অতিরিক্ত আশা দিলেন। বললেন, “তোমার হাতে ডকুমেন্ট আছে”? আমি বললাম, “জ্বি আছে।” তখন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সিগারেটে লাইটার ঠুকে বললেন, “নিউজ করো!”
আমার নিজের অফিস দোন-মনা হলেও, ঢাকা অফিস আমার পাশে শক্তভাবে ছিলো। তৎকালীন সমকালের বার্তা সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি (বর্তমানে সম্পাদক) নিউজটি একাধিকবার ক্রসচেক করলেন ! একটু সেন্সেটিভ রিপোর্ট এত কম বয়সী কেউ সরেজমিন করলো, তিনি বেশ গুরুত্ব দিয়েই দেখলেন। সম্পাদনা করতে গিয়ে উনি এবং চিত্ত দা (ঢাকা আফিসে ‘চট্টগ্রাম ডেস্ক’ দেখতেন, উনার পদ মনে নেই) ক্রসওভার ফোন দেন কয়েকবার। বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ছফা ভক্ত হিসেবে কোন বায়াজনেস কাজ করেছে কিনা নিউজটি করতে। আমি বলেছিলাম, আমার হাতে পর্যাপ্ত ডকুমেন্ট আছে এবং আমি সরেজমিন গিয়েছি। স্থানীয় প্রতিনিধি (প্রয়াত) শহীদ উদ্দীন চৌধুরীও অনুসন্ধানে আমাকে সাহায্য করেছিলেন।
তো একটি ভালো নিউজ পাঠানোর পর মফস্বল সাংবাদিকদের উত্তেজনায় রাতে ঘুম হতো না। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। পরদিন সকাল হলো। বটতলী ট্রেন স্টেশনে গিয়ে ক্যাম্পাসের শাটলে যাওয়ার আগে চেরাগি পাহাড় থেকে সমকাল কিনে চোখ ছানাবড়া! ছাপা কাগজে সমকালের শেষ পাতায় (কিংবা থার্ড পেইজ) দেখি বক্স স্টোরি। সারাদিন অনেক প্রতিক্রিয়া পেলাম। শুধু তাই নয়, নিউজের শেষে ‘অর্থ সাহায্য’ চেয়ে সমকাল চট্টগ্রাম ব্যুরোর ঠিকানা ও ফোন নম্বর থাকায় সপ্তাহখানেক শুধু ফোন রিসিভ করতে হয়েছিলো আমাকে। ফোনের ওপাশে যেমন ছিলো সহযোগিতার সুর, তেমনি ছিলো আমাকে চন্দনাইশে গেলে মেরে ফেলারও হুমকি। আজ আহমদ ছফার জন্মদিন। খুব মনে পড়লো রিপোর্টটির কথা।
আহমদ ছফা বলেছিলেন, “জীবন শিল্প নয়, কবিতা নয়। জীবনে যা ঘটে শিল্প এবং কবিতায় তা ঘটে না। জীবন জীবনই। জীবনের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না এবং জীবন ভয়ানক নিষ্ঠুর। সমস্ত প্রতিশ্রুতি, সমস্ত প্রতিজ্ঞা, সমস্ত স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের ওপারে জীবনের লীলাখেলা।” ছফার বোনের বাড়িতে গিয়ে আমার এই কথাগুলোই বারবার মনে হচ্ছিলো।
আমাদের অনার্স প্রথম বর্ষে ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ বইটি ছিলো এডিটিং ক্লাসের অবশ্যপাঠ্য। বইটি ছিলো স্যাটায়ার এবং নৈরাশ্যবাদে ভরা। আমি ছিলাম প্রচন্ড জীবনবাদী মানুষ। তাই খুব ভালো লাগেনি। কিন্তু “যদ্যপি আমার গুরু” পড়ে আশা জাগলো মনে। সেই থেকে পুরোপুরি ছফাভক্ত আমি। এরপর “পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ” পড়ে ভিন্ন এক জীবনবাদী ছফাকে পাই। তাঁর “রাজনীতির লেখা” এবং “অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী” পড়ে নিজেকে বেশ বুদ্ধিজীবী ভাবা শুরু করলাম। একদিন এক বড়ভাই ধরিয়ে দিলেন “বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস ও সমসাময়িক বাংলাদেশ”। বইটি পড়তে যে ম্যাচুইরিটি দরকার তা আমার ছিলো না। তাই ওটা পড়ি আরো পরে।
তো সমকালের নিউজটি ছিলো আহমদ ছফার বোনকে নিয়ে। যিনি অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছিলেন। এদিকে আহমদ ছফার বই নিয়ে তখন প্রকাশনা শিল্পে দেদারসে ব্যবসা চলছে। ফলে এই বিপরীত বাস্তবতা তুলে ধরতে গিয়ে আমি কথিত ইন্টেলেকচুয়েলদের বিরাগভাজন হই! শুনেছি কেউ কেউ আমার তৎকালীন ব্যুরো প্রধানকে এও বলেছিলেন, “এই ছেলে চবির নিউজ বাদে অন্য দিকে ঝোঁক কেন?” এগুলো কারা করেছেনছ তা সংযুক্ত নিউজটি পড়লেই বুঝতে পারবেন!
চন্দনাইশ থেকে ফেরার পথে আমার কেবল মনে হলো একরাশ অসহায়ত্ব আর বেদনা আমাকে ঘিরে ধরছে। আমার কি কিছুই করার নেই! জাসদের মুখপাত্র দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকা বন্ধ হয়ে পড়ায় ছফা খুব ভেঙ্গে পড়েন। মনে হতে থাকে এতদিন মরীচিকার পেছনে ছুটে অনর্থক সময় নষ্ট করেছেন। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাবার সময় বাসার ফেরার পথে কোন একদিন রাস্তায় একটি থেতলালো বেগুনের চারা পান। পরে সেটাকে নিয়ে এসে রোপন করে দেন। একদিন না যেতেই দেখা গেল চারাটি পায়ের উপর দাঁড়িয়ে গেছে। ছফা নিজেকে মেলান- ‘আছে, এখনো আমার আশা আছে। আমি আবার নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করতে পারি..’
আমি শুধুমাত্র ছফা ভাইকে ভালোবাসি এই কারণে। একটা নেতিয়ে যাওয়া বেগুনের চারাকে তিনি সতেজ করা শিখিয়েছেন। একটি পাখিকে ঘরের ঘুলঘুলিতে আশ্রয় দিয়েছেন! আজ সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়েছি আট বছর হয়। কিন্তু ছফার শিক্ষা ভুলি নি। আমার ক্লাসের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের আমার ছফা ভাইয়ের থেঁতলে যাওয়া বেগুন গাছ মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে হৃদয়ভেঙ্গে যাওয়া কোন শিক্ষার্থীকে দেখলে ছফা ভাইয়ের পাখিটিকে মনে পড়ে।