পাঠ প্রতিক্রিয়া: খবরের ভেতর খবর– আশিস সৈকত
এক সময় খবরের কাগজই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু যখন থেকে রাজনীতিই খবরের কাগজকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলো, তখনই খবর হয়ে গেল রাজনৈতিক স্বার্থনির্ভর। সাংবাদিকতা তখন পরিণত হলো কবি তারাপদ রায় এর কবিতা, ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’র রূপকে। আমরা টের পাইনি ‘আমাদের ঝরণা কলম কবে ডট্ পেন হয়ে গেছে’। ফলে পাঠকদের সর্বনাশ হয়ে গেল। খবরের কাগজের এই মান পড়ে যাওয়া, হুট করেই হয়নি। এই সর্বনাশ হওয়ার আগে সংবাদপত্রে কী চলছিলো, রাষ্ট্র কারা চালাচ্ছিলো, সাংবাদিকতার প্রভাব কতদূর ছিলো? এসব নিয়ে একটা অসাধারণ আত্ম-বিশ্লেষণমূলক বই বাজারে এসেছে। এই লেখা সেই বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়া।
বাঙালি স্বভাবতই সমালোচনা প্রবণ। সেই ব্রিটিশ বিরোধিতা থেকে শুরু করে পাকিস্তান বিরোধিতা, মুজিব বিরোধিতা, এরশাদ বিরোধিতার হাত ধরে হাল আমলের আওয়ামী বিরোধিতার সংস্কৃতি দেখলে মনে হয়, বাঙালি বোধহয় কেবল বিরোধিতা করার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু একটি ন্যায়ের দাবির পিছনে কতগুলি অন্যায় লুকিয়ে থাকিতে পারে, বিরোধিতার সংস্কৃতি সমাজে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধন করতে পারে; সম্প্রতি প্রকাশিত ‘খবরের ভেতরের খবর’ বইটি তার অভ্রান্ত উদাহরণ।
বাংলাদেশের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় সাংবাদিক আশিস সৈকতের অনুসন্ধানী রিপোর্ট বিষয়ক বই ‘খবরের ভেতরের খবর’। বইতে প্রথম আলোতে দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশিত ১৫ টি ‘অনুসন্ধানী রিপোর্ট’ এর পেছনের ‘খবর’ তুলে ধরেছেন লেখক, প্রকাশ করেছে ‘স্বরবৃত্ত’।

আশিস সৈকত বাংলাদেশের সাড়া জাগানো একজন সাংবাদিক। জমকালো সব প্রতিবেদন দিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন দেশে। মাঝে বছর দশেক কাগজে তাঁর দেখা নেই। অথচ টিভিতে ফেরার আগেও জাতীয় সংসদ বিটের অল্পস্বল্প প্রতিবেদন করেও নিজের উপস্থিতি জানান দিতেন তিনি। ফের সব চুপ। অতঃপর বইমেলায় ‘বোমা’ ফাটিয়েছেন এক সময়ের কলমসৈনিক, বর্তমান টিভিব্যক্তিত্ব আশিস সৈকত। বইটি পড়ে, আমার মন উত্তাল হয়েছে। ফিরে গিয়েছি আমার কৈশোরের শুরুতে ‘স্বপ্ন দেখার ব্যারাম’ হওয়ার দিনে। যখন সাধ ছিলো সাংবাদিক হবো। ভাগ্যগুণে ছাত্রজীবন শেষ না হতেই ঢাকার এক স্বনামধন্য ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রকাশিতব্য পত্রিকা দৈনিক জাগরণ-এ কাজের ডাক এলো। সেদিন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছিলাম। কারণ ছাত্র জীবনে যার প্রতিবেদন পড়ে পড়ে সাংবাদিকতা শেখার সুপ্ত ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছিলো, তিনিই আমার চিফ রিপোর্টার হয়েছেন! আমাদের সম্পাদক ছিলেন স্বনামধন্য সাংবাদিক আবেদ খান। আমি মূলত কাজের সুযোগ পাই নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি ভাইয়ের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। কিন্তু বিধিবাম! আমাদের জাগরণ আর ‘জাগলো না’। আশিস দা’ ফিরে গেলেন দৈনিক ইত্তেফাকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক পদে। আমি দৈনিক সমকালে সাতমাস কাজ করে, পেশার বাঁক বদল করে, নেশা জারি রেখে চলে আসি সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু আশিস দা’কে সবসময় বলে এসেছি, আপনার মতো গুণী, মেধাবী, সৃজনশীল ও অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকরা যতদিন সংবাদপত্রে থাকবেন, ততদিন আমাদের মতো নবীশ সাংবাদিকরা আশার আলো ফিরে পাবে। কিন্তু না, আশিস দা’ চলে গেলেন দৈনিকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক পদে। মন খারাপ হলো ভীষণ। তার স্বনামে প্রতিবেদনগুলো মিস করতে থাকলাম।
নয় বছর আগে সাংবাদিকতার শিক্ষকতায় যুক্ত হওয়ার পর আমার ব্রত নিয়েছিলাম, শিক্ষার্থীদেরকে সাংবাদিকতার নেপথ্যের দিকটি নিয়ে সবসময় ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো। সে অনুযায়ী ক্লাসে ও ক্লাসের বাইরে সাধ্যমতো প্রচেষ্টা থাকে, দেশের সাংবাদিকতা শিল্প এবং আলোচিত সাংবাদিকদের কাজ ও তৎপরতার দিকে শিক্ষার্থীদেরকে আগ্রহী করে তোলা। আমার সেই ব্রতে বাংলাদেশ-ভারতের বহু অগ্রজ সাংবাদিক আমাকে সাড়া দিয়েছেন। করোনাকালের নিস্তরঙ্গ অবসাদের জীবন ছাড়াও এর আগে-পরে আমার শ্রেণীকক্ষে কিংবা ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে বাংলাদেশ- ভারতের নানান সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও সংবাদ ব্যাক্তিত্বকে মুখোমুখি করিয়েছি আমার শিক্ষার্থীদের। তাঁদের সাংবাদিক হয়ে উঠার গল্পটি জানতে চেয়েছি, আমার শিক্ষার্থীদের সাথে একসঙ্গে বসে। আজ আমার সেই কাজটির বারোআনা বাস্তবায়ন করেছেন সাংবাদিক আশিস সৈকত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াতে গিয়ে আমি সবসময় শিক্ষার্থীদের জোর দিই সম্পাদিত প্রতিবেদন দেখে বেশি খুশি হওয়ার কারণ নেই। বরং সেই প্রতিবেদনটি কিভাবে জন্ম হলো তার গল্পটি সবসময় জানার চেষ্টা করো। অর্থাৎ, একটি আইডিয়া কিভাবে বার্তা ব্যবস্থপনা থেকে রিপোর্টার হয়ে সোর্স থেকে আবার পত্রিকায় এসে পরদিন পাঠকের কাছে যায়, সেই গল্পটি জানতে হবে। ছাপা প্রতিবেদনের ‘ইতি’ ও ‘নেতি’বাচক সাড়াকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। খবরের পেছনের খবর তাই আমার আগ্রহের জায়গা।
আশিস সৈকতের গ্রন্থটি পনেরোটি সাড়া জাগানো প্রতিবেদন দিয়ে রচিত। এতে তিনি রিপোর্টগুলোর পেছনের খবর, প্রতিক্রিয়া, সোর্সের ভূমিকা, বার্তা কক্ষ এবং পাঠক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন। তিনি ঝরঝরে গদ্যতে প্রতিটি সংবাদের সাথে জুড়ে দিয়েছেন নির্মোহ অনুভূতি। দলীয় পক্ষপাতমুক্ত এমন সরস গদ্য নবীন সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের জন্য আবশ্যিক পাঠ্য হওয়া উচিত। তবে বইটি পড়ে মনে হলো বইমেলার প্রকাশনা বা বাজার ধরার একটি তীব্র চেষ্টা ছিলো, যা প্রকাশনা হিসেবে শৈল্পিক মানে পুরোপুরি ‘এপ্লাস’, তা বলা কঠিন।
তবে এটি কেবল বই তো নয়! পাতায় পাতায় অজানা কাহিনী! পৃষ্ঠার ভাঁজে ভাঁজে জেগে উঠবে নবীন সাংবাদিকদের স্বপ্ন। দেশের সাংবাদিকতার সামগ্রিক বেহাল দশায় এমন একটি উষ্ণ বই পেয়ে অনুরাগী মহল উত্তাল হওয়ারই কথা। প্রচ্ছদ দুর্দান্ত। দামও শিক্ষার্থীদের নাগালের মধ্যে। খোলামেলা কথাবার্তায় ভরপুর। যত্নে ও আদরে তো বটেই, তীব্র স্বপ্ন না থাকলে এই বই লেখা সম্ভব নয়। বইটি যেন গোটা বাঙালি মিডিয়া দুনিয়াকে জোর গলায় রবি ঠাকুরের সুরে জানান দেওয়া, ‘আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে, তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে’! আমিও ‘না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে’ বইটির প্রতিটি প্রতিবেদনেই পাই রাষ্ট্র বনাম সাংবাদিকতার লড়াইয়ের গল্প। প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রধান সংবাদ হিসেবে ছাপা হয় এসব সংবাদ। চাট্টিখানি কথা নয়। বইটিতে চমৎকার একটি সূচনা লিখেছেন সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি। যদিও বন্ধুকৃত্যের উষ্ণতায় তিনি নিরপেক্ষ থাকতে পারেননি। পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে বসে যেমনটি পারিনি আমি নিজেও। বইয়ের ফ্ল্যাপে আশিস সৈকতের লেখক পরিচিতিতে বলা হয়েছে ‘বার্তাকক্ষ তার কাছে উপাসনার জায়গা’। আমার এক কলকাতার বন্ধু এই বাক্যটি পড়ে এতটাই মুগ্ধ হলেন যে, আমিও আশিস সৈকতের মতো উপাসনামুখি খবর-ভক্তকে নিয়ে খবরভোক্তার উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলাম। আজ থেকে প্রায় ১০/১২ বছর আগে, আমার বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালীন এবং ঢাকাইয়া সাংবাদিকতার বহুবিচিত্র সময়ে অল্প কয়েকজন সাংবাদিককে নিবিড়ভাবে চিনেছিলাম। জীবনের পরতে পরতে যারা স্মৃতি হয়ে বলে, ‘কেমন আছো, রাজীব’? সত্যিই, আমার ভীষণ অচল ও ব্যর্থ জীবনের গতিময়তা হিসেবে সেই অগ্রজদের কাজ দেখলে মনে হয়, ওটা যেন আমরাই কাজ। তাই এই বই নিয়ে আমার এত উচ্ছ্বাস।
বইয়ের প্রথমেই রয়েছে, ‘ল্যান্ড ক্রুজার ও প্রাডো সাংসদদের পছন্দ’ শিরোনামে একটি শক্তিশালী রিপোর্টের নেপথ্যের খবর। ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদনটি প্রথম আলো পত্রিকায় লিডি নিউজ আকারে প্রকাশিত হয়। খবরটি দেশজুড়ে সাড়া ফেলে, শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ নিয়ে সাংসদরা ব্যয়বহুল ল্যান্ড ক্রুজার ও প্রাডো গাড়ি কেনার কেলেঙ্কারি নিয়ে এই প্রথম কলম ধরলো কেউ। সংবাদ প্রকাশের পর এসব বিলসী গাড়ির অবাধ শুল্কমুক্তিতে লাগাম টানে সরকার। তখন জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ (বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি)। তিনি সাংসদদের জন্য সর্বোচ্চ সিসি ও ব্রান্ডের নাম নির্ধারণ করে দেন, যা বর্তমান সংসদেও বহাল রয়েছে। এই রিপোর্টের ফলে শুল্কমুক্ত সুবিধায় সংসদ সদস্যরা অতি দামি ব্রান্ডের গাড়ি কিনতে পারছেন না, এখনো।
এরপর রয়েছে ‘সংসদের জন্য ছয়টি লিফট, স্পিকার জানেন না’ শিরোনামের প্রতিবেদন ৯ আগস্ট, ২০১০ সালে প্রকাশিত হওয়ার প্রতিবেদনটি। যেখানে উঠে আসে জার্মানি থেকে লিফট কেনার কথা থাকলেও সেগুলো কেনা হয় কোরিয়া থেকে। বিষয়টি সম্পর্কে একেবারেই অবগত ছিলেন না তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদ। এছাড়াও বইতে রয়েছে ২০০৭ সালের ১৯ ডিসেম্বরে ‘মির্জা আব্বাসের পেট্রল পাম্প দুর্নীতি: ১২ লাখ টাকার ইজারা হয়ে গেল ৯৩ লাখ’ এর নেপথ্যের শিউরে উঠার মতো গল্প।
‘সংসদ ভবনের পশ্চিম প্রান্তে আসাদ গেট-সংলগ্ন এলাকায় পূর্ত অধিদপ্তরের একটি পেট্রল পাম্প বরাদ্দের ব্যাপারে ক্ষমতার অপব্যাবহার করেছিলেন তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাস। তার সময়ে নিয়ম লঙ্ঘন করে ওই পাম্পটি বছরে মাত্র ১২ লাখ টাকা হিসেবে ইজারা দেয়া হয় মন্ত্রীর ছোটভাই মির্জা খোকনের ব্যবসায়িক অংশীদার আহমেদ ইকবালের নামে।’ আশিস সৈকত লিখেছেন এই স্টোরি করার আগে ও পরের অভিজ্ঞতা। এছাড়াও ২০০৬ সালের ১৩ মার্চ ‘চিফ হুইপ বাসার জন্য চাল ডাল টাকা সবই নেন সংসদ থেকে’- প্রতিবেদনটিতে তৎকালীন চিফ হুইপ খোন্দাকার দেলোয়ার হোসেনের প্রসঙ্গ উঠে আসে। তবে আমি নানান বিবেচনায় এই বইতে সেরা রিপোর্ট হিসেবে রাখবো ‘দলীয় সফরে ঢাকার বাইরে যেতে সংসদ থেকে গাড়ির তেল নিয়েছিলেন তারেক’ প্রতিবেদনের কাহিনীকে। ‘খালেদার পরিবারের হাতে ঘুরে পটলের হাতে মাতাসাগর’, ‘মন্ত্রীর বাড়ির সামনে শেষ হলো জেলা সড়ক’, ‘ঘাস কাটতে কোটি টাকা স্পিকার জানেন না কিছুই কাজ পেয়েছেন বিএনপি নেতা’, ‘উত্তর-দক্ষিণ দুই ভাগ হচ্ছে ঢাকা সিটি করপোরেশন’, ‘বাংলাদেশের তাল পড়ে ভারতে’, ‘অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও’, ‘হাওর এলাকার জন্য দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প’, ‘রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন নিয়ে বিভ্রান্তি’ এমন বাহারি শিরোনামের প্রতিটি রিপোর্টের পেছনের গল্পগুলো অনবদ্য। বইটির শেষে চমক আছে ‘প্রথম আলোকে শেখ হাসিনা: জলবায়ু সম্মেলনের পর সবার দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে’ শিরোনামে প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। আশিস সৈকত খোলামেলা এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আড্ডার সুরে। ফলে কেবল প্রতিবেদক হিসেবেই নয়, বরং সাক্ষাৎকারগ্রহীতা হিসেবেও পাঠকদেরকে তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছাকাছি নিয়ে যান।
বইতে বেশ কিছু বানান ভুল রয়েছে। এছাড়াও পৃষ্ঠা সম্পাদনা ত্রুটি কাটিয় উঠতে পারলে পরবর্তী প্রকাশনায় বইটি হয়ে উঠবে আরো সার্থক। এমনিতেও বই প্রকাশের পর যা হওয়ার তা-ই হয়! অনুরাগী, পাঠকদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভেসেছেন আশিস সৈকত। নাম যার সৈকত তিনি দীর্ঘদিন চুপচাপ থেকে সৈকতের নুড়ি কুড়ানো শ্রম দিয়ে প্রমাণ করলেন ‘সবুরে মেওয়া ফলে’ কি একেই বলে?
আশিস সৈকতের জন্ম গাজীপুরে, বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই ১৯৯০ সালে সাংবাদিকতার শুরু সাপ্তাহিক ঢাকা পত্রিকায়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোয় মাঠে থেকে রিপোর্টিং করেছেন সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, পূর্বাভাস, সুগন্ধা, রোববারসহ নানা পত্রিকায়। খবরের কাগজ, পূর্বকোণের ঢাকা অফিস হয়ে ১৯৯৮ সালে যোগ দেন প্রথম আলোয়। সেখানে টানা ১৪ বছরের রিপোর্টিং জীবন। এরপর ইত্তেফাকে ৬ বছর সাংবাদিকতা শেষে ২০১৭ সালে যোগ দেন ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে।
এই আলোচনার শুরুতেই বলেছি, একটি ন্যায়ের দাবির পিছনে কতগুলি অন্যায় লুকিয়ে থাকতে পারে। এই বই তার অভ্রান্ত উদাহরণ। একটি সাধারণ বই কী ভাবে ক্রমে ক্রমে দৈনিক পত্রিকার প্রতিদিনের রিপোর্টিংকে রাজনৈতিক প্রশ্নে পরিণত করে তোলে, গোটা দেশকে তোলপাড় করতে পারে, এ যেন তারই কালের সাক্ষী। তৎকালীন সরকার পদে পদে যে অপার ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছেন, জনগণের, বিশেষত ভোটারদের, নজর সরিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, আশিস সৈকত সেই প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে শানে নুযুল বয়ানে সুলুক সন্ধান করেছেন।
বাংলাদেশে বহুদিন ধরে ‘পলিটিক্যাল ইজ্জতি সাংবাদিকতা’, ‘ফেসবুক ইউটিবের নেটিজেন সাংবাদিকতা’, ‘কর্পোরেট হীরন্ময় নীরবতা সাংবাদিকতা’ দেখে যাচ্ছি। আশিস সৈকত ‘কলমপেষা’র কাজটি ছেড়ে দেয়ার পর ঢাকাইয়া সাংবাদিকতার ট্রিগার পয়েন্ট এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আইনে। রাষ্ট্রে এখন শক্তিশালী অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা ভীষণ চাপের কাজ। আবার রাষ্ট্রও তাঁর জনসংযোগ ব্যবস্থার সংকটে পড়ে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। এখন এমন অবস্থায় বাংলাদেশে সাংবাদিকতার তেমন কোন সুযোগ নেই, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা তো দূর অস্ত। এইরকম পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতা পেশায় আজ দ্বৈততা কাজ করছে। এটি একদিকে ‘অতি লোভনীয়’ কিন্তু ‘অনিশ্চিত’ হয়ে উঠছে। সাংবাদিকতা এখন বিরাট ফ্রেন্ড সার্কেলের একমাত্র ডাকসাইটে সুন্দরীর মত। দূর থেকে ‘হাসে’, ‘ভ্রুপল্লবে চন্দনের বনে’ যাওয়ার ইশারা দেয় কিন্তু ‘ভরসা’ দেয় না। আশিস সৈকতের বইটি প্রমাণ করে দেয়, সত্যিকারের সাংবাদিকতা করার কাজটি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। যদিও সাংবাদিকতা হলো থ্যাঙ্কসলেস জব, অনেকটা উইকেট কিপিংয়ের মতো। বল ধরলে বাহবা নেই, ছাড়লেই দর্শকসারি থেকে শুরু করে পত্রিকা পাঠকরা চেঁচিয়ে উঠবে- ক্যাচ মিস কেন? সেই ক্যাচ মিস হওয়ার প্রশ্নের উত্তর দেয় আশিস সৈকতের বইটি। যদিও বইপুস্তক পড়ে সাংবাদিকতার কিছু শেখা হয়না। সাংবাদিকতা হলো প্রায়োগিকবিদ্যা। আপনি যতই বই পড়েন, ভালো নাম্বার পান, বড় জোর ‘মুর্খ তোতাপাখি’ হতে পারবেন। সাংবাদিকতা যতটা না তাত্ত্বিক, তার চাইতেও বেশি ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক জ্ঞান। এই বইটি সার্বিক অর্থে সাংবাদিকতার ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক জ্ঞানঅন্বেষণ প্রচেষ্টার সুযোগ।
বাংলাদেশের মতো বিকাশমান সমাজে সংবাদপত্র একটি শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম হিসেবে কাজ করে। পাঠককে শিক্ষিত করে তোলে, বিনোদন দেয়, মনের ও চিন্তার খোরাক জোগায়। সংবাদপত্রকে বলা হয় প্রতিদিনের ইতিহাস। কারণ দৈনিক পত্রিকা পরদিন হয় কাগজের ঠোঙা, না হয় সেরদরা মাপের পণ্য। কিন্তু আশিস সৈকতের রিপোর্টগুলোর পুরাতন সব কপি দৈনিক পত্রিকায় পাঠকের ঘর থেকে সের দলে বিক্রিত হয়ে গেলেও, এতটুকু ‘বিক্রিত’ হয়নি। খবরের পেছনের খবর জানতে যারা আগ্রহী, একেবোরে ‘কবর’ খুঁড়ে ‘খবর’ খুঁজে বের করার মতো ঘাড়ত্যাড়া স্বপ্ন যাদের আছে, সেসব জেদি সাংবাদিকদের জন্য এই বই অবশ্যপাঠ্য। পরিশেষে কবিগুরুর সুরে লেখককে জানাই গভীর কৃতজ্ঞতা। এই বইটি যেন-
‘আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে
তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে..
তুমি অলখ আলোকে নীরবে দুয়ার খুলে
প্রাণের পরশ দিয়ে যাও মোর কাজে’।