অনলাইন সাংবাদিকতা: পাঠ ও প্রয়োগ

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এক যুগসন্ধিক্ষণ পর্বে অবস্থান করছে। পদ্ধতিগতভাবে এদেশের সাংবাদিকতায় একটি নীরব পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ছাপা কাগজ এবং বৈদ্যুতিন সম্প্রচার, এই দুই ধারার সাংবাদিকতা স্ব স্ব পরিসর ছেড়ে অনলাইনে হাজিরা দিতে বাধ্য হচ্ছে। সাংবাদিকতার প্রযুক্তিগত ও ব্যবহারিক সকল ধারণা নবায়নেরও সময় এসেছে। কেবল কি নবায়ন? না, বাতিলও করে দিতে হচ্ছে বহুকিছু। ছাপা কাগজকে এখন ‘ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগবিধি’তে বিবেচনা করতে হচ্ছে। কারণ, একজন পাঠক এখন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে আপডেটেড হয়ে যাচ্ছেন। অনলাইন মাধ্যম সহজলভ্য ও সঞ্চরণশীল হওয়ায় পাঠকের স্বচ্ছন্দ্য বিচরণ চলে। পরদিনের ছাপা কাগজে নতুন করে পাঠকরা আর একই ঘটনা জানতে চাইছেন না। ফলে সাংবাদিককে কেবল লেখা বা ভিডিওতে দক্ষ হলে চলবে না। বরং দৃশ্য-শ্রাব্য-কথ্য-লেখ্য—চার মাধ্যমেই সচল থাকতে হচ্ছে। না চাইলেও সাংবাদিকদের এই বহুমুখী ‘লাইনে’ নিয়ে এসেছে ‘অনলাইন সাংবাদিকতা’। ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী ও দাপুটে পত্রিকার। আবার অনলাইন প্রযুক্তি ও ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগানে দেখা দিয়েছে নতুন ধরণের সাংবাদিকতার সম্ভাবনাও। ওল্ড মিডিয়ার বিদায়ঘণ্টা বাজার সময়ে নিউ মিডিয়ার অনিবার্য উপস্থিতিতে বলা যায় সাংবাদিকতার যুগসন্ধিক্ষণ পরিস্থিতি। বাংলাদেশে এখন জনপ্রিয় হচ্ছে অনলাইন ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম। ঠিক সেই সময়য়টাতে বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার ‘পরিপূর্ণ গাইডলাইন’ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের তিন তরুণ বিদ্যোৎসাহী গবেষক, শিক্ষক, সাংবাদিক। যে বইটির নাম- ‘অনলাইন সাংবাদিকতা: পাঠ ও প্রয়োগ’।

অতিমারি হানা দেওয়ার পরে অনলাইন বিশ্বের এক অভূতপূর্ব ভূমিকা দেখেছিল বাংলাদেশ, তথা গোটা বিশ্বও। ঠিক সেসময় অনলাইন সাংবাদিকতাকে আরও সমৃদ্ধ করতে স্বনামধন্য প্রকাশনী ও মননশীল পুস্তক বিপনীকেন্দ্র বাতিঘর থেকে প্রকাশিত হলো অনলাইন সাংবাদিকতার ওপর বিদ্যায়তনিক পরিশ্রমী এই কাজটি। অনলাইন সাংবাদিকতার ওপর পূর্ণাঙ্গ কোনো বাংলা বই নেই, এই তাড়না থেকেই সাংবাদিকতার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়ের ওপর বইটি লিখেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাজী এম. আনিছুল ইসলাম, প্রথম আলোর সিনিয়র সহসম্পাদক সাইফুল সামিন ও দ্য ডেইলি স্টারের সহসম্পাদক মো. সুমন আলী। শিল্পী সব্যসাচী হাজরার প্রচ্ছদে বইটি উপস্থাপনাগত কারণেই আকর্ষণীয়। ৩৪৩ পৃষ্ঠার বইটিতে রয়েছে ‘সাড়ে নয়টি’ অধ্যায়, যা মোট ২৯টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত।

বইয়ের নামটিই বইটির পরিচয়কে তুলে ধরে— ‘পাঠ ও প্রয়োগ’; অর্থাৎ শিরোনাম বলছে বইটি সাংবাদিকতার তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক আলোচনার দাবী করে। সাংবাদিকতার ওপর বিস্তর লেখাপত্রের মাঝে এই বইটি আলাদা একটি মাত্রা যুক্ত করেছে। কারণ, লেখকবৃন্দ বাংলা সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক জগতে একটি কঠিন বিষয়কে সহজে এই প্রথম তুলে ধরার কৃতিত্বের দাবীদার। বইটির প্রথম তিনটি অধ্যায় অনলাইন সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হলেও, পরের অধ্যায়গুলো চমৎকার বিশদ বিবরণ। তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহার। বইটি আগাগোড়া একটি প্রশ্নকে খাড়া করে, অনলাইন সাংবাদিকতা কী? সাংবাদিকতা পেশার দায়িত্ব বলতে সংবাদ প্রকাশ বোঝালেও, মাধ্যমের পরিবর্তনের কারণে আজকের দিনে সংবাদ পরিবেশনের ধরন পাল্টে গেছে। সংবাদ প্রকাশ করাই এখন সাংবাদিকদের একমাত্র কাজ নয়। অনলাইনের দাপটে একজন সাংবাদিককে একসাথে একাধিক কাজ করতে হচ্ছে। এই বইতে কখনো আমরা দেখি সাংবাদিককে ব্যাকপ্যাক জার্নালিস্ট বলা হচ্ছে, কখনো বলা হচ্ছে মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট।

আমাদের পূর্বপুরুষরা দেখেছেন, সভ্যতাঘাতি দুটো বিশ্বযুদ্ধ সাংবাদিকতার জগতে গভীর প্রভাব ফেলেছিলো। যুদ্ধের ফলাফল দ্রুত পৌঁছে দিতে সংবাদ পরিবেশন পদ্ধতিতে এসেছিলো পরিবর্তন। মানুষের কাছে কত আগে যুদ্ধের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ খবরটি পৌঁছে দেওয়া যায় সে জন্য ইউরোপ-আমেরিকার কাগজে দেখা দিয়েছিল সাংবাদিকতার বিকাশ। কিন্তু এখন ‘বিশ্বের ৬২ শতাংশ মানুষ এখন মনে করছে, ডিজিটাল মিডিয়া তাদেরকে চলমান ঘটনাবলি সম্পর্কে খুব ভালো করেই আপডেটেড রাখতে পারছে। আর নিউজ মিডিয়াগুলো ব্রেকিং নিউজ সরবরাহেও ভালো করছে। খবরের ব্যাখ্যার চেয়ে খবরটি জানিয়ে দিতে তারা আস্থার সাথে কাজ করতে পারছে (সূত্র: রয়টার্স ইনস্টিটিউট ডিজিটাল নিউজ রিপোর্ট ২০১৯)। এছাড়াও করোনাকালে দেশে-দেশে মৃত্যুমিছিল, লকডাউন, কর্মক্ষেত্রে ধস, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মানসিক স্থিতিতে আঘাত দিয়ে কোভিড-১৯ পরিবর্তন এনেছে সাংবাদিকতারও। ইতিহাসের এই বিষণ্ণ সময়ে বইটি একটি ঐতিহাসিক দলিল, বিভিন্ন অধ্যায়ে অনলাইন সাংবাদিকতার অধুনিক সব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে ধাপে ধাপে। যেমন: মোবাইল সাংবাদিকতা, ডেটা সাংবাদিকতা, সাংবাদিকতায় ড্রোনের ব্যবহার, সাংবাদিকতায় ব্যবহৃত বিভিন্ন অ্যাপ, অনলাইন সাংবাদিকতার সংবাদকক্ষ, মাল্টিমিডিয়াসহ অনলাইন সাংবাদিকতা জানতে যা যা প্রয়োজন তার অধিকাংশ বিষয় পাওয়া যাবে বইটিতে।

প্রকাশনা সংস্থা এই বইতে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে। বইটি প্রকাশের আগে ‘রিভিউ’ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক ও আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. মো. গোলাম রহমান এবং অপরাজেয় বাংলার সম্পাদক মাহমুদ মেনন খান। পাণ্ডুলিপিকে ঘষেমেজে তৈরি করা, কিছু তথ্যগত ভুল ঠিক করা আর প্রুফ পড়া— গ্রন্থ-সম্পাদকের কাজ। সেক্ষেত্রে বাতিঘর ধন্যবাদ পাওয়ার দাবীদার। এই বইয়ের প্রায় প্রতিটি নিবন্ধ সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক ধারার প্রচলিত প্রকাশনাগুলো থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। জনপ্রিয় গ্রন্থপ্রকাশের ধারা থেকে আলাদা এই অবস্থান দেখিয়ে দেয় লেখক-সম্পাদকদের পরিশ্রমের মূল্য কতটা। নিছক পেশাগত পদোন্নতির সোপানস্বরূপ লোকচক্ষুর অন্তরালে গুরুগম্ভীর গবেষণাগ্রন্থ নয় এটি, এটি নয় জ্ঞানতাত্ত্বিক পণ্ডিতি আলোচনা। বরং বলা ভালো, এটি সহজ সরল বাংলায়, চমৎকার, সময়োযোগী উদাহরণে গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন একটি পরিপূর্ণ বিদ্যায়তনিক পাঠ্যবই। এই বইয়ের বিশেষ সম্পদ হলো অধ্যবসায়। তাই অধ্যাপনা, শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতা পেশায় যাঁরা যুক্ত, তাঁরা জেনে খুশি হবেন যে, তিন লেখকের অন্তর্দৃষ্টি, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, ধৈর্য্য, পরিশ্রম, প্রতিশ্রুতি এবং পেশার প্রতি প্রতিশ্রুতি সবকিছুর সমন্বয় হয়েছে এই বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে।

বইয়ের ভূমিকায় বলা হয়েছে এই বই লেখার পরিকল্পনা প্রায় চার বছর আগের। মহামারি কনোরার সময়টাকে লেখকবৃন্দ সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। এটি বেশ সাধুবাদ পাওয়ার মতোই একটি ব্যাপার। উন্নয়ন যোগাযোগের আলোচনায় একসময় যেমন নিউ প্যারেডাইম এবং ওল্ড পেরাডাইম নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো, বইটি আমাদেরকে আজকের দিনে ওল্ড মিডিয়া ও নিউ মিডিয়ার সমান্তরাল তুলনামূলক বিশ্লেষণকে হাজির করে।

বইয়ের প্রথম অধ্যায়: ধারণা ও ইতিহাস। দুটি পরিচ্ছেদ আছে এখানে- অনলাইন সাংবাদিকতা: সংজ্ঞায়ন, বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য ও ধরন এবং অনলাইন সাংবাদিকতার ইতিহাস। বইটির শুরুর অধ্যায়ে বলা হচ্ছে চৌদ্দশ পঞ্চাশ সালের দিকে জার্মান নাগরিক জোহানেসবার্গ মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে শুধু যোগাযোগ বিপ্লবই ঘটাননি, মানুষের সৃষ্টি ও সৃজনশীলতাকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। বইয়ের শুরুতে মার্শাল ম্যাকলুহানের ভবিষ্যদ্বাণীকে ধরে আগানো হয়েছে যে, প্রযুক্তির হাত ধরেই পুরো পৃথিবী পরিণত হবে বিশ্বগ্রামে। ভবিষ্যদ্বাণীটি যেন সত্যিই মনের কথাটি হয়ে বেজেছে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে অর্থাৎ অনলাইন সাংবাদিকতার ইতিহাস আলোচনায় খুব চমৎকারভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় অণুজীববিজ্ঞানের প্রয়াত অধ্যাপক আইজেক আজিমভের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী দিয়ে শুরু হয়েছে। অনলাইন সাংবাদিকতার ধারণা ও ইতিহাস আলোচনায় আমরা ৩৯ পৃষ্ঠায় দেখতে পারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রকাশিত পত্রিকা নিউজ থেকে প্রথম অনলাইন কনভারজেন্স কিংবা মাল্টিমিডিয়া প্রভৃতি পরিভাষায় ব্যবহৃত সংবাদ প্রচার শুরু হয়। যদিও এই অধ্যায়ে বাংলাদেশে কবে থেকে অনলাইন সাংবাদিকতা শুরু সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ব্যাখ্যায় আসেনি। বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার যাত্রা কোন সাংবাদিকের হাত ধরে শুরু সেটিও এই অধ্যায়ে (বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার ইতিহাস রচনায় অত্যন্ত যা গুরুত্বপূর্ণ) ঘাটতি হিসেবে রয়ে গেল।

দ্বিতীয় অধ্যায়: অনলাইন সংবাদকক্ষ ও সংবাদ। এতে আটটি পরিচ্ছেদ, যথা: অনলাইন সংবাদকক্ষ ও সংবাদপ্রবাহ, অনলাইন সংবাদ: প্রস্তুতি ও তথ্য সংগ্রহ, অনলাইন সংবাদ : সূচনা ও কাঠামো, অনলাইন সংবাদের শিরোনাম, অনলাইন সংবাদ লেখা ও সম্পাদনা, অনলাইনে আন্তর্জাতিক সংবাদ : তথ্য সংগ্রহ ও লিখন, অনলাইন সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা, অনলাইন সাংবাদিকতায় আয় ও ব্যয়। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের হাত ধরে অনলাইন সাংবাদিকতার বিবর্তনকে দেখানো হয়েছে এখানে। তবে বইতে বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার প্রারম্ভিক তথ্য নিয়ে নির্দিষ্ট কোন দিন ক্ষন নেই বলা হয়েছে- যেটি গবেষকদের পক্ষ থেকে কিছুটা ঘাটতি হিসেবে থেকে যায়।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ এর অনলাইন সংবাদ এর সূচনা ও কাঠামো আলোচনাতে চমৎকারভাবে সিএনএন এবং বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যম এর দুটি সংবাদ এর সূচনা কে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে এছাড়াও সংবাদপত্রের সংবাদ এবং অনলাইনের সংবাদ এর মধ্যে একটি কাঠামো এবং ছক করে সূচনা সংবাদের ‘বডি’ নিয়ে চমৎকার আলোচনা করা হয়েছে।

অনলাইন সংবাদের শিরোনাম পরিচ্ছদে দেখা হয়েছে মূলত ভার্চুয়াল গেটওয়ের মাধ্যমে কিভাবে অনলাইন সাংবাদিকতা পরিচালিত হয়। লেখকবৃন্দ বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার সংবাদের শিরোনামে কিছু স্বতন্ত্র এবং শিরোনামের প্রকারভেদ তুলে ধরেছেন। অনলাইন সংবাদ কক্ষ ও সংবাদ বিভাগের আলোচনায় বলা হচ্ছে- সন্দেহ হলে বাদ দিন (হয়েন ডাউট কাট ইট আউট)।

তৃতীয় অধ্যায়: কনভার্জেন্স/মাল্টিমিডিয়া। দু’টি পরিচ্ছেদ আছে এখানে, যথা: কনভার্জেন্স: সংজ্ঞা ও ধরন, মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম। চতুর্থ অধ্যায়: নিউজ ওয়েবসাইট। এতে চারটি অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে নিউজ ওয়েবসাইট ডিজাইন: কৌশল ও উদ্দেশ্য, ওয়েবসাইটের কারিগরি ও প্রাযুক্তিক দিক, হাইপারলিংক: সংজ্ঞা, প্রকার ও ধরন, ওয়েবসাইটে তথ্য উপস্থাপনকৌশল। পঞ্চম অধ্যায়: মোবাইল সাংবাদিকতা: প্রক্রিয়া ও সম্পাদনা। এখানে দু’টি পরিচ্ছেদ, যথা: মোবাইল সাংবাদিকতা : সংজ্ঞা, ইতিহাস ও কৌশল, ভিডিও সম্পাদনা: প্রসঙ্গ কিনেমাস্টার। ষষ্ঠ অধ্যায়: ডেটা সাংবাদিকতা: তত্ত্ব ও প্রয়োগ। দু’টি পরিচ্ছেদে এখানে আলোচনা করা হয়েছে ডেটা সাংবাদিকতা: সংজ্ঞা, ইতিহাস ও চর্চা এবং ইনফোগ্রাম: ডেটা সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। সপ্তম অধ্যায়: নয়া মাধ্যম ও নয়া সাংবাদিকতা’য় পাঁচটি পরিচ্ছেদ। যেমন: অনলাইন সাংবাদিকতা ও সামাজিক মাধ্যম, সাংবাদিকতায় ড্রোনের ব্যবহার: ধারণা ও গুরুত্ব, পডকাস্ট: ধারণা ও কৌশল, সাংবাদিকতায় ব্যবহৃত বিভিন্ন অ্যাপস, ভুয়া সংবাদ: ধারণা ও যাচাইপ্রক্রিয়া। অষ্টম অধ্যায়: বিকল্পধারার সাংবাদিকতা। এখানে দুটি পরিচ্ছেদ। যেমন: নাগরিক সাংবাদিকতা, ব্লগ: ধারণা, ইতিহাস ও চর্চা। নবম অধ্যায়: অনলাইন নীতিমালা, আইন ও নিবন্ধন। দুটি পরিচ্ছেদে এখানে আলোচনা করা হয়েছে অনলাইন মাধ্যম নীতিমালা ও নিবন্ধনপ্রক্রিয়া এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮। এভাবেই বইটি একটি গোছানো আলাপের মতো সার্থক পরিণতির দিকে নিয়ে যায় পাঠকদের। তবে, এই বইতে একটু ঘাটতি রয়ে গেছে অনলাইন সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতা‘র আলোচনায়। এখানে অনেক বিশদে হতে পারতো আলাপটি। বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার জায়গাগুলো দারুণভাবে আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক। কিন্তু অধ্যায়টি সাড়ে তিন পৃষ্ঠা না যেতেই অতৃপ্তি রেখে শেষ হয়ে যায়! তবে প্রাসঙ্গিকভাবেই একটি চমৎকার স্টোরিবোর্ড দেয়া হয়েছে বইতে। স্টোরিবোর্ডের বিষয়ে দেয়া হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাদকাসক্তদের মাদক সম্পর্কিত অপরাধ নিয়ে মাল্টিমিডিয়া স্টোরি তৈরি করা। এই ধরণের সুপরিকল্পিত আউটলাইন শিক্ষার্থী ও অনলাইন সাংবাদিককের কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ায়। বইয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো গণমাধ্যম থেকে সর্বসাম্প্রতিক হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যমে মাল্টিমিডিয়ার সংবাদ শিরোনামগুলো সচিত্র সন্নিবেশিত করা।

বইটির বৈশিষ্ট্য, মিডিয়া বা গণমাধ্যমকে কেন্দ্রস্থলে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বহুমুখী উদাহরণে সমৃদ্ধ এই বই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে সমালোচনার উর্ধ্বে নয় এই বইটি। বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্যের যথাযথ সূত্র ব্যবহার না করে লেখকবৃন্দ এড়িয়ে গেছেন, যা হয়তো অনিচ্ছাকৃত কিন্তু বইটি যেহেতু বাংলায় অনলাইন সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক ভূবনে প্রথম কোন প্রকাশনা, সুতরাং রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহারের প্রয়োজনে পরবর্তী সংস্করণে লেখকবৃন্দ ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠবেন বলে আশা রাখি। বইয়ে কিছু মুদ্রণপ্রমাদও রয়েছে, যা অনিচ্ছ্কৃত। তবুও লেখকবৃন্দের এই প্রচেষ্টা সার্থক। কারণ এই বই প্রশ্ন তুলেছে পোস্ট-ট্রুথ বা সত্য-উত্তর সংবাদ দুনিয়ার বাস্তবতা নিয়ে। এই বই উন্মোচন করেছে অনলাইন সাংবাদিকতার নামে ‘ক্লিকবেইট’ এর সস্তা জনপ্রিয় ধারাকে। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যে বেখেয়ালী সাংবাদিকতার জন্য ‘লেমস্ট্রিম মিডিয়া’য় পরিণত হতে পারে, সেই সতর্কতা দেখা যায় পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক আলোচনায় বইটি প্রথম তো বটেই, একটি ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা হিসেবেও ধরা যেতে পারে।

সবশেষে পরিশিষ্ট পাঠের মাধ্যমে বইটি পড়া ‘শেষ হইয়াও হইলো শেষ’ অনুভূতি জেগেছে। সেজন্য কায়দা করে লেখার শুরুতে বলেছি এটি ‘সাড়ে নয়টি’ অধ্যায়ে বিভক্ত। একদম শেষে ‘করোনাকালীন অনলাইন সাংবাদিকতা’ নামে বাড়তি কিন্তু অত্যন্ত সময়োপোযোগী একটি অধ্যায় আমাদের উপহার দিয়েছে বইটি। এরপর একদম শেষে রয়েছে ‘পরিভাষা’, যা আমাদের অনলাইন সাংবাদিকতার বিভিন্ন শব্দের অর্থকে সংক্ষেপে পরিচিতি দেয়, সহজবোধ্য সংজ্ঞায়নের সাথে পরিচয় করায় পাঠকদের। সংক্ষেপে আভিধানিক অর্থ জানানোর এই উদ্যোগ খুব ভালো।

“পৃথিবীর অনেক দেশে নামকরা অনেক সংবাদপত্রের ছাপা সংস্করণ বন্ধ হয়ে গেছে, তারা শুধু অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করছে। টেলিভিশনের দর্শকও ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সাংবাদিকতা এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও ব্যবসায়িক—তিন দিক থেকেই একটা ক্রান্তিকাল।” (সূত্র: সাংবাদিকতা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি: মাহ্ফুজ আনাম, প্রথম আলো/ ০৩-১১-২০১৯) আবার এই মুদ্রার উল্টাপিটও আছে। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ তার ইউকিলিক্স-কাণ্ডে দেখিয়ে দিয়েছেন অনলাইন সাংবাদিকতা চাইলে কী করতে পারে! এডওয়ার্ড স্নোডেন তার গুপ্তচরবৃত্তির পরিসর ভেঙে অনলাইন দুনিয়ার নতুন চেহারা হাজির করেছেন। অনলাইন সাংবাদিকতা তাই আজ মোবাইল জার্নালিজম (মোজো), ডাটা জার্নালিজম, সাংবাদিকতায় প্রোগ্রামিংয়ের ব্যবহারসহ নানা মাত্রায় নতুন নতুন রূপ হয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। সাংবাদিকতার জন্য এটি একটি মহা-চ্যালেঞ্জ। এই আধুনিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতাকে যুক্ত করতে না পারলে বা নিজেকে প্রশিক্ষিত না করলে গ্লোবাল চ্যালেঞ্জে টিকে থাকা অসম্ভব। বইটির গুরুত্ব এতটাই যে, অভিধানের মতো ‘এ’ থেকে ‘জেড’ তালিকায় সাজানো বইটি। অনলাইন সাংবাদিকতার নামে যখন ভুয়া খবরের বেসাতিতে আসল খবর পাওয়া মুশকিল, কিংবা ব্রেকিং নিউজের নামে ভুল খবরের ছড়াছড়ি, সেসময় সংবাদের প্রতি পৃথিবী ক্রমশ ভরসা হারিয়ে ফেলছে। তাই বেলাইনে চলা অনলাইন সাংবাদিকতা ও সাংবাদিককে রক্ষা করতে এই বই জরুরিতর।

সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক গ্রন্থ-সম্পাদনার উদ্যোগ বাংলাদেশে অনেক দেখা যায়। কিন্তু সিরিয়াস প্রকাশনা সে অনুপাতে কই? সেখানে তিন তরুণের পরিশ্রমের প্রতি কিছুটা পূর্বধারণা থাকায়, আমার আশা এখনও আমার মরতে মরতেও মরেনি। বইটি পড়তে পড়তে আমি টের পেয়েছি অভূতপূর্ব পরিশ্রমের পরিচয়। অনলাইন সাংবাদিকতার এই যুগসন্ধিক্ষণে বইটি পাঠ করে সাংবাদিকতার শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক সকলেই লাভবান হবেন, এই গ্যারান্টি দেয়া যেতেই পারে। একটু রস করে বললে, হাল আমলের সাংবাদিকতায় আগ্রহী সবাইকে ‘লাইনে’ নিয়ে আসবে ‘অনলাইন’ সাংবাদিকতার এই নতুন বাংলা বইটি।